১. আগুন যাকে ছোঁয় না...
বাংলা ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থরাজির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থগুলোর একটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। বাংলার বাইরেও ইংরেজি, উর্দু, স্পেনিশ, জার্মান, চীনা, জাপানিসমেত অনেকগুলো ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে। আরও বহু ভাষাতে অনুবাদের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, এই অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পান্ডুলিপিসমেত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত অজস্র দলিলপত্র ও নথি একদা পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল তার প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশে। প্রথমবার তা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে, তারা ২৬ মার্চ আবার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে তার বাসভবন লুণ্ঠন করে। তার লেখা আত্মজীবনীর কাগজপত্রগুলোকে তাদের কাছে ততটা মূল্যবান মনে হয়নি, সেগুলো তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে গিয়েছিল। শত্রুকবলিত সেই বাড়িটি থেকে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলের সঙ্গী হয়ে সেই রুলটানা খাতাগুলো উদ্ধার করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই স্মৃতিচারণ তিনি করেছেন কারাগারের রোজনামচার ভূমিকায়–
আমার মা আমাকে বললেন, ‘একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক, তোর আব্বার লেখা খাতাগুলো যেভাবে পারিস নিয়ে আসিস।’ খাতাগুলো মার ঘরে কোথায় রাখা আছে, তাও বলে দিলেন। আমাদের সঙ্গে মিলিটারির দুটি গাড়ি, ভারী অস্ত্রসহ পাহারাদার গেল।
২৫ মার্চের পর এই প্রথম বাসায় ঢুকতে পারলাম। সমস্ত বাড়িতে লুটপাটের চিহ্ন, সব আলমারি খোলা, জিনিসপত্র ছড়ানো-ছিটানো। বাথরুমের বেসিন ভাঙা, কাচের টুকরা ছড়ানো, বীভৎস দৃশ্য!
বইয়ের শেলফে কোনো বই নাই। অনেক বই মাটিতে ছড়ানো, সবই ছেঁড়া অথবা লুট হয়েছে। কিছু তো নিতেই হবে। আমরা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাই, পাকিস্তান মিলিটারি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যায়। ভাই-বোনদের বললাম, যা পাও বইপত্র হাতে হাতে নিয়ে নাও।
আমি মায়ের কথামতো জায়গায় গেলাম। ড্রেসিং রুমের আলমারির ওপর ডানদিকে আব্বার খাতাগুলো রাখা ছিল, খাতা পেলাম কিন্তু ‘ সঙ্গে মিলিটারির লোক, কী করি? যদি দেখার নাম করে নিয়ে নেয়, সেই ভয় হলো। যা হোক, অন্য বই-খাতা কিছু হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে একখানা গায়ে দেওয়ার কাঁথা পড়ে থাকতে দেখলাম, সেই কাঁথাখানা হাতে নিলাম, তারপর এক ফাঁকে খাতাগুলো ওই কাঁথায় মুড়িয়ে নিলাম।
আমার মায়ের হাতে সাজানো বাড়ির ধ্বংস স্তুপ দেখে বারবার চোখে পানি আসছিল কিন্তু‘ নিজেকে শক্ত করলাম। খাতাগুলো পেয়েছি এইটুকুই বড় সান্ত্বনা। অনেক স্মৃতি মনে আসছিল।
যখন ফিরলাম মায়ের হাতে খাতাগুলো তুলে দিলাম। পাকিস্তানি সেনারা সমস্ত বাড়ি লুটপাট করেছে, তবে রুলটানা এই খাতাগুলোকে গুরুত্ব দেয়নি বলেই খাতাগুলো পড়েছিল।
‘আব্বার লেখা এই খাতার উদ্ধার আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরাধের ফসল।’ (শেখ হাসিনা রচিত ভূমিকা, কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৮-৯, বাংলা একাডেমি, ২০১৭)
ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার একটি পর্যালোচনায় উল্লেখ করেন : ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আত্মজীবনী প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, এমন গুঞ্জন উঠলে বাংলাদেশে কারও কারও ভ্রূকুঞ্চিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় এই আত্মকাহিনীর কথা শোনা যায়নি, তাই এর অকৃত্রিমতায় তারা আস্থা রাখতে পারেননি। এখন জানা যাচ্ছে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু না-হওয়া শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে বন্দি ছিলেন, সে সময় বেগম ফজিলাতুনেড়বছা মুজিব তাকে তার জীবনের কাহিনী লিখতে অনুরোধ করেছিলেন।... আত্মজীবনী লেখার প্রস্তাব শেখ মুজিব প্রথমে নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি লিখতে পারেন না বলে, তার ওপর, তা লিখে কী হবে, এমন ভেবে। শেষে স্ত্রীর পুনরায় অনুরোধে একদিন তিনি কারাগারে বসেই আত্মকথা লিখতে শুরু করেন। চারটি খাতায় তা লেখা হয়েছিল।’ (‘ইতিহাসের উপাদান মানবিক দলিল’, আনিসুজ্জামান, প্রথম আলো সাহিত্যপাতা, ২২ জুন ২০১২)
নিয়তির পরিহাস, গুরুত্ব অনুভব করেনি বলে পাকিস্তানিরা অসমাপ্ত আত্মজীবনী বিনষ্ট করায় মনোযোগী হয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন করা বাংলাদেশে তার অর্জনকে বিনষ্ট করতে চাওয়া লোক জনাকয়েক হলেও ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ইতিহাস মুছে দেওয়ার এবং ইতিহাসকে ঘুরিয়ে দেওয়ার যে চূড়ান্ত ও তৎপরতা শুরু হয়, অসমাপ্ত আত্মজীবনীর একটি অনুলিপিসহ বঙ্গবন্ধুর নাম ও কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত বহু প্রামাণ্য দলিল তার হাত থেকে মুক্ত থাকেনি। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ভূমিকায়–
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে পরিবারের সবাইকে হত্যার পর তৎকালীন সরকার বাড়িটা বন্ধ করে রেখেছিল। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আমি প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আসি। তখনো বাড়িটা জিয়া সরকার সিল করে রেখেছিল। আমাকে ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয়নি। এরপর ওই বছরের ১২ জুন সাত্তার সরকার আমাদের কাছে বাড়িটা হস্তান্তর করে। তখন আব্বার লেখা স্মৃতিকথা ডায়েরি ও চীন ভ্রমণের খাতাগুলো পাই। আত্মজীবনী লেখা খাতাগুলো পাইনি। কিছু টাইপ করা কাগজ পাই, যা উইপোকা খেয়ে ফেলেছে। ফুলস্কেপ পেপারের অর্ধেক অংশই নেই শুধু ওপরের অংশ আছে। এসব অংশ পড়ে বোঝা যাচ্ছিল যে, এটি আব্বার আত্মজীবনীর পান্ডুলিপি, কিন্তু যেহেতু অর্ধেকটা নেই, সেহেতু কোনো কাজেই আসবে না। এরপর অনেক খোঁজ করেছি। মূল খাতা কোথায় কার কাছে আছে জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। একপর্যায়ে এগুলোর আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। (শেখ হাসিনা রচিত ভূমিকা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা x, ইউপিএল, ২০১২)
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মূল খাতাটি এভাবে কয়েক যুগের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিমাখা সব ঐতিহাসিক দলিলপত্রাদি বিনষ্টেরও একটা তোড়জোড় জোরদারভাবেই চলছিল। রীতিমতো ফরমান জারি করে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে কর্মকর্তা নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধুরই প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশে এগুলোকে পুড়িয়ে দেওয়ার মহোৎসব চলেছে বঙ্গভবনে, সেখানে থাকা অসমাপ্ত আত্মজীবনীর আরেকটি টাইপ করা কপিসহ আরও বহু দলিলপত্রের কোনো কিছুই যেন রেহাই না পায়, তার জন্য কঠোর হুকুম জারি করেছিল তৎকালীন সরকার। এই বহ্নুৎসবের বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার রচিত বঙ্গভবনে পাঁচ বছর (ইউপিএল, ১৯৯২) গ্রন্থে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত ইতিহাসের অমূল্য সব নিদর্শন এভাবে পুড়িয়ে ফেলার নজির সভ্য দুনিয়াতে খুব বেশি মিলবে না।
ইতিহাস মুছে ফেলার এত আয়োজনের পরও কীভাবে তা রক্ষা পেল, তা নিয়েও একটা বিশদ গবেষণা হওয়া এবং উত্তর প্রজন্মের জন্য গ্রন্থাকারে সংরক্ষিতও থাকা প্রয়োজন। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভবিষ্যতের ইতিহাসবেত্তারা ভস্মীভূত হতে গিয়ে কালোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার এই দৃষ্টান্তটিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরবেন। এর একটা সবিস্তার বিবরণ অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থদ্বয়ের ভূমিকায়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এই অংশটুকু আপাতত উদ্ধৃত করা যাক, যেখান থেকে আমরা জানতে পারি, অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সেই রুলটানা মূল খাতাগুলো কোথায় সংরক্ষিত রয়ে গিয়েছিল, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর সেই বিষাদময় সময়ে এই কাগজগুলো উদ্ধারের রোমাঞ্চকর কাহিনী–
‘আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভী রহমানসহ চব্বিশজন মৃত্যুবরণ করেন। আমি আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যাই। এ ঘটনার পর শোক-কষ্ট-বেদনায় যখন জর্জরিত, ঠিক তখন আমার কাছে এই খাতাগুলো এসে পৌঁছায়। এ এক আশ্চর্য ঘটনা। এত দুঃখ-কষ্ট বেদনার মধ্যেও যেন একটু আলোর ঝলকানি। আমি ২১ আগস্ট মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। মনে হয় যেন নতুন জন্ম হয়েছে। আর সে সময় আমার হাতে এলো আব্বার হাতের লেখা এই অমূল্য আত্মজীবনীর চারখানা খাতা! শেষ পর্যন্ত এই খাতাগুলো আমার এক ফুফাতো ভাই এনে আমাকে দিল। আমার আরেক ফুফাতো ভাই বাংলার বাণী সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সে এই খাতাগুলো পেয়েছিল। সম্ভবত আব্বা শেখ মণিকে টাইপ করতে দিয়েছিলেন, আত্মজীবনী ছাপাবেন এই চিন্তা করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনিও শাহাদতবরণ করায় তা করতে পারেননি। কাজটা অসমাপ্ত রয়ে যায়।’
‘খাতাগুলো হাতে পেয়ে আমি তো প্রায় বাকরুদ্ধ। এই হাতের লেখা আমার অতি চেনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে ডাকলাম। দুই বোন চোখের পানিতে ভাসলাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি; তারপরই এই প্রাপ্তি। মনে হলো যেন পিতার আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছি। আমার যে এখনো দেশের মানুষের জন্য– সেই মানুষ, যারা আমার পিতার ভাষায় বাংলার দুঃখী মানুষ– সেই দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজ বাকি, তার স্বপেড়বর সোনার বাংলা গড়ার কাজ বাকি, সেই বার্তাই যেন আমাকে পৌঁছে দিচ্ছেন। যখন খাতাগুলোর পাতা উল্টাছিলাম আর হাতের লেখাগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম, আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আব্বা আমাকে যেন বলছেন, ভয় নেই মা, আমি আছি, তুই এগিয়ে যা, সাহস রাখ। আমার মনে হচ্ছিল, আল্লাহর তরফ থেকে ঐশ্বরিক অভয়বাণী এসে পৌঁছাল আমার কাছে। এত দুঃখ-কষ্ট বেদনার মাঝে যেন আলোর দিশা পেলাম। আব্বার হাতে লেখা চারখানা খাতা। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে খাতাগুলো নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। খাতাগুলোর পাতা হলুদ, জীর্ণ ও খুবই নরম হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় লেখাগুলো এত ঝাপসা যে পড়া খুবই কঠিন। একটা খাতার মাঝখানের কয়েকটা পাতা একেবারেই নষ্ট, পাঠোদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন। পরদিন আমি, বেবী মওদুদ ও রেহানা কাজ শুরু করলাম।’ (শেখ হাসিনা রচিত ভূমিকা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা xi-xii, ইউপিএল, ২০১২)
সাংবাদিক বেবী মওদুদ বেঁচে থাকলে অসমাপ্ত আত্মজীবনী সম্পাদনার ইতিহাস বিষয়ে বহু গল্প গবেষকরা তার কাছ থেকেই জানতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে এক আলাপচারিতার সময় তিনি দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেন কীভাবে তার পরম বন্ধু বেবী মওদুদের উৎসাহ ও লেগে থাকার স্পৃহা এই পান্ডুলিপিটি নিয়ে কাজ করার প্রক্রিয়াকে সম্ভব করেছিল।
অকালপ্রয়াত অধ্যাপক এনায়েতুর রহিমের কথাও শেখ হাসিনা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যিনি ২০০২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই চারটি খাতা পাওয়ার আগেকার পর্যায়ে প্রাপ্ত ডায়েরি ও স্মৃতিকথা অনুবাদ করেছেন বাংলা থেকে ইংরেজিতে।
এভাবে রক্ষা পাওয়া খাতাগুলো নিয়ে শুরু হয় সম্পাদনার কাজ। সম্পাদনার এই পর্ব বিষয়ে সম্পাদকদের অন্যতম অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান লিখেছেন : ‘বইটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমেদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ, আমি এবং অধ্যাপক ফকরুল আলম যুক্ত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর লেখা পান্ডুলিপি উদ্ধার এবং যত্নের সঙ্গে গভীর মমতায় রক্ষা করে সম্পাদনা ও প্রকাশনার মূল ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ছোট বোন শেখ রেহানাও এ কাজে ছিলেন তার সহযোগী।
‘আমরা যখন এই কাজটি শুরু করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলের নেত্রী। তিনি সুধাসদনে অবস্থান করতেন। নির্ধারিত দিনে আমরা প্রকাশনা ও সম্পাদনার কাজে যুক্ত হতাম। কাজ হতো আনন্দময় ও আন্তরিক পরিবেশে। তবে কাজ করতে হতো খুব সিরিয়াসলি এবং সতর্কতার সঙ্গে। কারণ পান্ডুলিপি তো আর কারও নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সবাই মিলে যখন কিছু কিছু করে পান্ডুলিপি তৈরি হচ্ছিল তখন, তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী নিজেই তা কম্পিউটারে কম্পোজ করে দিতেন। তার এই নিষ্ঠা এবং যুক্তি-দক্ষতা আমাদের অভিভূত করেছিল।’ (‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের ইতিহাস কথা’, শামসুজ্জামান খান, অন্য আলো, প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০১৬)
২. সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে...
অজস্রবার লুণ্ঠন, পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা কিংবা অবহেলায় উইপোকার খোরাক হতে হতে বেঁচে যাওয়া আত্মজীবনী এখন শুধু বাংলা ভাষায় বিপুল পঠিত গ্রন্থই নয়, পৃথিবীর প্রধানতম ভাষাগুলোতে অনূদিত একটি গ্রন্থ।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পূর্ণাঙ্গ পান্ডুলিপিটি কম্পোজ করা অবস্থায় ২০১০ সালে ইউপিএলের কাছে আসার পর তা বই আকারে প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত সময় লেগেছিল ঠিক দুই বছর। তবে পান্ডুলিপিটির সঙ্গে ইউপিলের প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদের যুক্ত হওয়ার প্রথম ঘটনাটি ঘটে তারও অনেক আগে। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে পড়াশোনা করছি এবং আমার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ আমার কাছে থাকতে এসেছেন কিছুদিনের জন্য। তখন একদিন আমার বাড়িতে ফোন করে বাবার সঙ্গে কথা বললেন জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এনায়েতুর রহিম। আমাদের পরিবারের সঙ্গে এনায়েতুর রহিম এবং তার স্ত্রী জয়েস রহিমের ঘনিষ্ঠতা অনেক বছরের। তার সম্পর্কে বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা ও ডায়েরি বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন। তখনো অসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতাগুলো বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে আসেনি। যখন তিনি বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তখন তিনি হাসপাতালে, মৃত্যুশয্যায়। বাবাকে বলেন যেন বাংলায় এবং ইংরেজিতে বইটি ইউপিএল প্রকাশ করে। অনুবাদের কাজটি তিনি আর শেষ করতে পারেননি; ৩১ মে ২০০৩ সালে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আরও দীর্ঘ ছয়-সাত বছর পর ড. সালাহ্উদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান এবং সাংবাদিক বেবী মওদুদ পান্ডুলিপিটি প্রকাশের আলোচনার উদ্দেশ্যে ইউপিএলে আসেন। দেশে বইটির যথাযথ বিপণন ও আন্তর্জাতিক প্রসারের পরিকল্পনা থেকেই আলাপ-আলোচনা শুরু হয়, চুক্তি সম্পাদিত হয় ৩০ জুলাই ২০১০ তারিখে। ইউপিএলের বদিউদ্দিন নাজির এবং মহিউদ্দিন আহমেদ, এই সম্পাদক-প্রকাশক জুটি দীর্ঘ দুই বছর পরিশ্রম করেন বইটির সম্পাদনা, টীকা তৈরি, নির্ঘণ্ট তৈরি থেকে নিয়ে বইটিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচার করার কাজে। পেঙ্গুইন ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গের রিজিওনাল ম্যানেজার নির্মাল্য রায়চৌধুরী ও দিল্লি অফিসে তখন কর্মরত সম্পাদক রঞ্জনা সেনগুপ্তের উদ্যোগে ইংরেজি সংস্করণটির বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের অন্য সব দেশে প্রচার করার জন্য ইউপিএলের সহ-প্রকাশক হিসেবে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া চুক্তিবদ্ধ হয় ২৮ অক্টোবর ২০১০ সালে। পাকিস্তানে ইংরেজি সংস্করণ এবং উর্দু সংস্করণের জন্য ৯ জুলাই ২০১১ সালে চুক্তি হয় করাচির অক্সফোর্ডের সঙ্গে। ২০১২ সালের জুন মাসে একযোগে বইটির বাংলা সংস্করণ ও ইংরেজি সংস্করণসমূহ প্রকাশিত হয়। ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের পক্ষে প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ ২০১২ সালের ১৯ জুনে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার ভূমিকা-সংবলিত শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটি এবং ফকরুল আলমকৃত এর ইংরেজি অনুবাদ রচয়িতার দুই কন্যার হাতে তুলে দেন।’ (‘ইতিহাসের উপাদান মানবিক দলিল’, আনিসুজ্জামান, প্রথম আলো সাহিত্য পাতা, ২২ জুন ২০১২)
এরপর ৯ জুলাই ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে একটি অত্যন্ত আবেগঘন প্রকাশনা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বইটির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাসহ বক্তব্য দেন অধ্যাপক মুস্তফা নুরউল ইসলাম (প্রয়াত), কবি সৈয়দ শামসুল হক (প্রয়াত) এবং সাংবাদিক বেবী মওদুদ (প্রয়াত)। বরেণ্য নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বাংলা বই থেকে এবং অনুবাদক অধ্যাপক ফকরুল আলম ইংরেজি থেকে পাঠ করেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন আসাদুজ্জামান নূর। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার বক্তব্যের সময় তারাসহ দর্শকের সারিতে আসীন প্রায় সহস্র মানুষের সম্ভবত কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
১৯৭১ সালের নিউজউইক পত্রিকার এপ্রিল মাসের সংখ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ হিসেবে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত অন্য দুটি গ্রন্থ পাঠ করলে বোঝা যায় যে, তিনি একজন উঁচুদরের সাহিত্যিকও বটে। কথাকার আনিসুল হক ২০১২ সালে আগস্ট মাসে প্রকাশিত তার গ্রন্থ-পর্যালোচনা এই বলেই শুরু করেছেন যে : “বাংলা সাহিত্য সম্পªতি লাভ করেছে এক ‘গ্রেট স্টোরিটেলার’কে। তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।” (‘এ গ্রেট স্টোরিটেলার’, আনিসুল হক, প্রথম আলো সাহিত্য পাতা, ২৭ আগস্ট ২০১২)
প্রকাশক হিসেবে ইউপিলের প্রধানতম সৌভাগ্য ও গর্ব যে, বঙ্গবন্ধু রচিত প্রথম বইটির প্রকাশক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাছাই করা হয়েছে তার পেশাদারিত্ব ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কারণে। এটি অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ যে মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যাপক পাইরেসি সত্ত্বেও এ যাবৎ বইটির বাংলা সংস্করণের পাঁচ লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে, দেশ ও দেশের বাইরে। ইংরেজি সংস্করণ বিক্রি হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। পাকিস্তানের উর্দু সংস্করণটিও তৃতীয়বারের মতো পুনর্মুদ্রিত হয়েছে ২০১৯ সালে। ২০১২ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বইটি একদিনের জন্যও মুদ্রিত নেই এমনটি ঘটেনি– এবং পাঠক ও পুস্তকবি তারা এ কারণে বরাবর ইউপিএলের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। বইটির স্বত্বাধিকারী বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টকে নিয়মিত বইয়ের বিক্রির হিসাব ও রয়্যালটি ইউপিএল পরিশোধ করে আসছে ইউপিএল।
অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী প্রকাশের এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বিরাট মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার আগে কেমন ছিলেন ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান, তার সাক্ষ্য রয়েছে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর প্রতিটি পাতায়। এই বইয়ের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে কালোত্তীর্ণ হওয়ার মতো– কারণ বাংলাদেশের প্রতিটি প্রজন্মকে তার ইতিহাস ও আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়ে যে কটি বইয়ের শরণাপনড়ব হতে হবে, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী তার অন্যতম। বইটির ভাষা আড়ম্বরহীন, অকপট, কোথাও অতিরঞ্জনের কোনো ছাপ নেই এবং তা যেকোনো পাঠককে আপন করে নিতে বাধ্য।
এই বই আমাদের চিনতে সাহায্য করে সত্যিকার রক্তমাংসের বঙ্গবন্ধুকে– পরমতসহিষ্ণু রাজনীতির চর্চায়, অন্যান্য মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনে যিনি শুধু একজন দলীয় নেতা ছিলেন না, ছিলেন একজন অধিকার ও ন্যায়সচেতন সর্বজনীন নেতা। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী ব্যক্তি, বর্তমানকে বিশেস্নষণ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত যেমন পৌঁছাতে পারতেন, তেমনি ভবিষ্যৎকে দেখার অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল তার।
আমি নিজে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ এবং তাদের একজন, যাদের স্কুল-কলেজ জীবনে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। সত্যিকার ইতিহাস জানার জন্য যাদের অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে এই লেখাটি লিখতে পারাটা আমার জন্য তাই বিশেষভাবে আনন্দের, সৌভাগ্যের ও সম্মানের এবং এই সৌভাগ্যের ঋণ অনেকের কাছে– যারা নানা রকম ঝুঁকি নিয়ে, নিঃস্বার্থ পরিশ্রম করে সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বইকে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসকে দেশ ও বিদেশে আরও অনেক পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের পাশাপাশি তাই একটা গভীর ব্যক্তিগত দায় আমি অনুভব করি। এই কাজটি আমরা সততা, পেশাদারিত্ব, যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাব, মুজিববর্ষে এটিই আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক