কি ঘটেছিল কারবালায়? কারা হুসাইন রাদিয়াল্লাহ আনহুকে হত্যা করেছে?

 
১) ভূমিকা:

প্রশংসা মাত্রই আল্লাহর জন্যযিনি বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)তাঁর পরিবার এবং সকল সাহাবীর উপর।
সৌভাগ্যবান শহীদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র সায়্যেদ হেসাইন ইবন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কারবালার প্রান্তরে শহীদ হওয়াকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনাই প্রসিদ্ধ রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের অনেক মুসলিমের মধ্যে এ বিষয়ে বিরাট বিভ্রান্তি রয়েছে। দেশের রাষ্ট্রপ্রতিপ্রধানমন্ত্রীবিরোধী দলীয় নেতাগণইসলামী বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ এ দিন উপলক্ষে জাতির সামনে প্রতিবছর বিশেষ বাণী তুলে ধরেন। রেডিওটেলিভিশনসংবাদপত্র এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে থাকে। এ দিন আমাদের দেশে সরকারী ছুটি থাকে। তাদের সকলের কথা ঘুরে ফিরে একটাই। স্বৈরাচারীজালেমনিষ্ঠুর ও নরপশু ইয়াযীদের হাতে এ দিনে রাসূলের দৌহিত্র ইমাম হুসাইন নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। এ জন্য এটি একটি পবিত্র দিন। বিশেষ একটি সম্প্রদায় এ দিন উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। বিষাদসিন্ধু নামক একটি উপন্যাস পড়ে বা এর কিছু বানোয়াট ও কাল্পনিক কাহিনী শুনে সুন্নি মুসলিমগণও এ বিষয়ে ধুম্রজালে আটকা পড়েছেন।
জাতির ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনের জন্য আজ আমি এ বিষয়ে সঠিক ও গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য প্রকাশ করার কাজে অগ্রসর হতে বাধ্য হলাম। মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে সংক্ষিপ্ত আকারে একটি ভূমিকা পেশ করতে চাই। মন দিয়ে ভূমিকাটি পড়লে মূল বিষয় বুঝতে সহজ হবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি আরও বিশ্বাস করি যেআমার লেখাটি পড়ে এ বিষয়ে অনেকের আকীদাহ সংশোধন হবে। আর যারা বিষয়টি নিয়ে সংশয়ে আছেনতাদেরও সংশয় কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ।
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন: প্রতিটি মুসলিমের উচিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র সায়্যেদ হসাইন ইবন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কারবালার প্রান্তরে শহীদ হওয়ার ঘটনায় ব্যথিত হওয়া ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তিনি ছিলেন মুসলিম জাতির নেতা ও ইমামদের অন্যতম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশ্রেষ্ঠ কন্যা ফাতেমার পুত্র ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু একজন বিজ্ঞ সাহাবী ছিলেন। তিনি ছিলেন একধারে বাদতগুজারদানবীর এবং অত্যন্ত সাহসী বীর। হাসান ও হুসাইনের ফযীলতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একাধিক সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। অন্তর দিয়ে তাদেরকে ভালবাসা ঈমানের অন্যতম আলামত এবং নবী পরিবারের কোনো সদস্যকে ঘৃণা করা ও গালি দেওয়া মুনাফেকির সুস্পষ্ট লক্ষণ। যাদের অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত কেবল তারাই ইমাম হুসাইন বা নবী পরিবারের পবিত্র সদস্যদেরকে ঘৃণা করতে পারে।
আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আতের আকীদাহ অনুযায়ী ইমাম হুসাইন বা অন্য কারও মৃত্যুতে মাতম করা জায়েয নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল মুসলিম জাতির বিরাট একটি গোষ্ঠী ইমাম হুসাইনের মৃত্যুতে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে থাকে। যারা হুসাইনের মৃত্যু ও কারবালার ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনতাদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন করা খুবই যুক্তিসংগত মনে করছি। যে সমস্ত সুন্নি মুসলিম সঠিক তথ্য না জানার কারণে এ ব্যাপারে সন্দিহান ও বিভ্রান্তিতে আছেন তাদের কাছেও আমার একই প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই প্রকৃত ঘটনা বুঝা খুব সহজ হবে ইনশা-আল্লাহ।
প্রথম প্রশ্ন: হুসাইনের পিতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলীফা আলী ইবন আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু হুসাইনের চেয়ে অধিক উত্তম ছিলেন। তিনি ৪০ হিজরী সালে রমযান মাসের ১৭ তারিখ জুমার দিন ফজরের নামাযের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় আব্দুর রহমান ইবন মুলজিম খারেজীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। তারা হুসাইনের মৃত্যু উদযাপনের ন্যায় তাঁর পিতার মৃত্যু উপলক্ষে মাতম করে না কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন: আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আতের আকীদাহ অনুযায়ী উসমান ইবন আফ্ফান ছিলেন আলী ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর চেয়ে অধিক উত্তম। তিনি ৩৬ হিজরী সালে যুলহজ্জ মাসের আইয়ামে তাশরীকে স্বীয় বাসভবনে অবরুদ্ধ অবস্থায় মালুমভাবে নিহত হন। ন্যায় পরায়ণ এই খলীফাকে পশুর ন্যায় জবাই করা হয়েছে। তারা তাঁর হত্যা দিবসকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান করে না কেন?
তৃতীয় প্রশ্ন: এমনভাবে খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু, উসমান এবং আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও উত্তম ছিলেন। তিনি ফজরের নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন এবং মুসলিমদেরকে নিয়ে জামা‘আতের ইমামতি করছিলেন। এমন অবস্থায় আবু লুলু নামক একজন অগ্নিপূজক তাঁকে দুই দিকে ধারালো একটি ছুরি দিয়ে আঘাত করে। সাথে সাথে তিনি ধরাশায়ী হয়ে যান এবং শহীদ হন। লোকেরা সেই দিনে মাতম করে না কেন?
চতুর্থ প্রশ্ন: ইসলামের প্রথম খলীফা এবং রাসূলের বিপদের দিনের সাথী আবু বকরের মৃত্যু কি মুসলিমদের জন্য বেদনাদায়ক নয়তিনি কি রাসূলের পরে এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন নাতার মৃত্যু দিবসে তারা তাজিয়া করে না কেন?
পঞ্চম প্রশ্ন: সর্বোপরি নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া ও আখেরাতে সমস্ত বনী আদমের সরদার। আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে অন্যান্য নবীদের ন্যায় স্বীয় সান্নিধ্যে উঠিয়ে নিয়েছেন। সাহাবীদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর চেয়ে অধিক বড় আর কোনো মুসীবত ছিল না। তিনি ছিলেন তাদের কাছে স্বীয় জীবনসম্পদ ও পরিবার-পরিজনের চেয়েও অধিক প্রিয়। তারপরও তাদের কেউ রাসূলের মৃত্যুতে মাতম করেন নি। হুসাইনের প্রেমে মাতালগণকে রাসূলের মৃত্যু দিবসকে উৎসব ও শোক প্রকাশের দিন হিসেবে নির্ধারণ করতে দেখা যায় না কেন?
ষষ্ঠ প্রশ্ন: সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে হুসাইনের চেয়ে বহুগুণ বেশী শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মৃত্যু দিবসকে বাদ দিয়ে ইমাম হুসাইনের মৃত্যুকে বেছে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি শুরু করা হল কেনএর উত্তর আমার এই লেখার শেষ পর্যায়ে উল্লেখ করেছি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেখাটি পাঠ করলে উত্তরটি সহজেই বোধগম্য হওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ সর্বোপরি ইসলামে কারও জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস পালন করার এবং কারও মৃত্যুতে মাতম করাউচ্চ স্বরে বিলাপ করা এবং অন্য কোনো প্রকার অনুষ্ঠান করার কোনো ভিত্তি নেই। শুধু তাই নয় এটি একটি জঘন্য বিদআতযা পরিত্যাগ করা জরুরী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা তাঁর কোনো সাহাবী কারও জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস পালন করেন নি।

২) কারবালার প্রান্তরে রাসূলের দৌহিত্র হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু নিহত হওয়ার প্রকৃত ঘটনা:
৬০ হিজরিতে ইরাকবাসীদের নিকট সংবাদ পৌঁছল যেহুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ইয়াযীদ ইবন মুআওয়িয়া হাতে বাইআত করেন নি। তারা তাঁর নিকট চিঠি-পত্র পাঠিয়ে জানিয়ে দিল যে ইরাকবাসীরা তাঁর হাতে খেলাফতের বাইআত করতে আগ্রহী। ইয়াযীদকে তারা সমর্থন করেন না বলেও সাফ জানিয়ে দিল। তারা আরও বলল যেইরাকবাসীরা ইয়াযীদের পিতা মুআওয়িয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতিও মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। চিঠির পর চিঠি আসতে লাগল। এভাবে পাঁচ শতাধিক চিঠি হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এসে জমা হল।
প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবন আকীলকে পাঠালেন। মুসলিম কুফায় গিয়ে পৌঁছলেন। গিয়ে দেখলেনআসলেই লোকেরা হুসাইনকে চাচ্ছে। লোকেরা মুসলিমের হাতেই হুসাইনের পক্ষে বাইআত নেওয়া শুরু করল। হানী ইবন উরওয়ার ঘরে বাইআত সম্পন্ন হল।
সিরিয়াতে ইয়াযীদের নিকট এই খবর পৌঁছা মাত্র বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য পাঠালেন। ইয়াযীদ উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদকে আদেশ দিলেন যেতিনি যেন কুফাবাসীকে তার বিরুদ্ধে হুসাইনের সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেন। সে হুসাইনকে হত্যা করার আদেশ দেন নি।
উবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি বিষয়টি তদন্ত করতে লাগলেন এবং মানুষকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। পরিশেষে তিনি নিশ্চিত হলেন যেহানী ইবন উরওয়ার ঘরে হুসাইনের পক্ষে বাইআত নেওয়া হচ্ছে।
অতঃপর মুসলিম ইবন আকীল চার হাজার সমর্থক নিয়ে অগ্রসর হয়ে দ্বিপ্রহরের সময় উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করলেন। এ সময় উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর ভয় দেখালেন। তিনি এমন ভীতি প্রদর্শন করলেন যেলোকেরা ইয়াযীদের ধরপাকড় এবং শাস্তির ভয়ে আস্তে আস্তে পলায়ন করতে শুরু করল। ইয়াযীদের ভয়ে কুফাবাসীদের পলায়ন ও বিশ্বাস ঘাতকতার লোমহর্ষক ঘটনা জানতে চাইলে পাঠকদের প্রতি ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ কর্তৃক রচিত মিনহাজুস সুন্নাহ বইটি পড়ার অনুরোধ রইল। যাই হোক, কুফাবাসীদের চার হাজার লোক পালাতে পালাতে এক পর্যায়ে মুসলিম ইবন আকীলের সাথে মাত্র তিন জন লোক অবশিষ্ট রইল। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুসলিম ইবন আকীল দেখলেনহুসাইন প্রেমিক আল্লাহর একজন বান্দাও তার সাথে অবশিষ্ট নেই। এবার তাকে গ্রেপ্তার করা হল। উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ তাকে হত্যার আদেশ দিলেন। মুসলিম ইবন আকীল উবাইদুল্লাহর নিকট আবেদন করলেনতাকে যেন হুসাইনের নিকট একটি চিঠি পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়। এতে উবাইদুল্লাহ রাজী হলেন। চিঠির সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল এ রকম:
হুসাইন! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও। কুফাবাসীদের ধোঁকায় পড়ো না। কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে। আমার সাথেও তারা সত্য বলে নি। আমার দেওয়া এই তথ্য মিথ্যা নয়।
অতঃপর যুলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ আরাফা দিবসে উবাইদুল্লাহ মুসলিমকে হত্যার আদেশ প্রদান করেন। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যেমুসলিম ইবন ‘আকীল ইতোপূর্বে কুফাবাসীদের ওয়াদার উপর ভিত্তি করে হুসাইনকে আগমনের জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠির উপর ভিত্তি করে যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। অনেক সাহাবী তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসআব্দুল্লাহ ইবনে উমরআব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরআব্দুল্লাহ ইবন আমর এবং তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফীয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইবনে উমর হুসাইনকে লক্ষ্য করে বলেন: হুসাইন! আমি তোমাকে একটি হাদীছ শুনাবো। জিবরীল আলাইহিস সালাম আগমন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়া এবং আখিরাত- এ দুটি থেকে যে কোনো একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি দুনিয়া বাদ দিয়ে আখিরাতকে বেছে নিয়েছেন। আর তুমি তাঁর অংশ। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কেউ কখনই দুনিয়ার সম্পদ লাভে সক্ষম হবেন না। তোমাদের ভালর জন্যই আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন। হুসাইন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং যাত্রা বাদ দিতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর ইবনে উমর হুসাইনের সাথে আলিঙ্গন করে বিদায় দিলেন এবং ক্রন্দন করলেন।
সুফীয়ান ছাওরী ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেন যেইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হুসাইনকে বলেছেন: মানুষের দোষারোপের ভয় না থাকলে আমি তোমার ঘাড়ে ধরে বিরত রাখতাম।
বের হওয়ার সময় আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু হুসাইনকে বলেছেন: হোসাইন! কোথায় যাওএমন লোকদের কাছেযারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে এবং তোমার ভাইকে আঘাত করেছে?
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: হুসাইন তাঁর জন্য নির্ধারিত ফয়সালার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছেন। আল্লাহর শপথ! তাঁর বের হওয়ার সময় আমি যদি উপস্থিত থাকতামতাহলে কখনই তাকে যেতে দিতাম না। তবে বল প্রয়োগ করে আমাকে পরাজিত করলে সে কথা ভিন্ন। (ইয়াহ্-ইয়া ইবনে মাঈন সহীস সূত্রে বর্ণনা করেছেন)
যাত্রা পথে হুসাইনের কাছে মুসলিমের সেই চিঠি এসে পৌঁছল। চিঠির বিষয় অবগত হয়ে তিনি কুফার পথ পরিহার করে ইয়াযীদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার পথে অগ্রসর হতে থাকলেন। পথিমধ্যে ইয়াযীদের সৈন্যরা আমর ইবন সাশাির ইবন যুল জাওশান এবং হুসাইন ইবন তামীমের নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের গতিরোধ করল। হুসাইন সেখানে অবতরণ করে আল্লাহর দোহাই দিয়ে এবং ইসলামের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনটি প্রস্তাবের যে কোনো একটি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহবান জানালেন।
হুসাইন ইবন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং রাসূলের দৌহিত্রকে ইয়াযীদের দরবারে যেতে দেওয়া হোক। তিনি সেখানে গিয়ে ইয়াযীদের হাতে বাইআত গ্রহণ করবেন। কেননা তিনি জানতেন যেইয়াযীদ তাঁকে হত্যা করতে চান না। অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেওয়া হোক। অথবা তাঁকে কোনো ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দেওয়া হোক। সেখানে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত বসবাস করবেন এবং রাজ্যের সীমানা পাহারা দেয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। (ইবনে জারীর হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন)
ইয়াযীদের সৈন্যরা কোনো প্রস্তাবই মানতে রাজী হল না। তারা বলল: উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ যেই ফয়সালা দিবেন আমরা তা ব্যতীত অন্য কোনো প্রস্তাব মানতে রাজী নই। এই কথা শুনে উবাইদুল্লাহর এক সেনাপতি (হুর ইবন ইয়াযীদ) বললেন: এরা তোমাদের কাছে যেই প্রস্তাব পেশ করছে তা কি তোমরা মানবে নাআল্লাহর কসম! তুর্কী এবং দায়লামের লোকেরাও যদি তোমাদের কাছে এই প্রার্থনাটি করততাহলে তা ফেরত দেওয়া তোমাদের জন্য বৈধ হত না। এরপরও তারা উবাইদুল্লাহর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেই দৃঢ়তা প্রদর্শন করল। সেই সেনাপতি ঘোড়া নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলেন এবং হুসাইন ও তাঁর সাথীদের দিকে গমন করলেন। হুসাইনের সাথীগণ ভাবলেন: তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসছেন। তিনি কাছে গিয়ে সালাম দিলেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে এসে উবাইদুল্লাহর সৈনিকদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদের দুইজনকে হত্যা করলেন। অতঃপর তিনিও নিহত হলেন। (ইবনে জারীর হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন)
সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে হুসাইনের সাথী ও ইয়াযীদের সৈনিকদের মধ্যে বিরাট ব্যবধান ছিল। হুসাইনের সামনেই তাঁর সকল সাথী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হলেন। অবশেষে তিনি ছাড়া আর কেউ জীবিত রইলেন না। তিনি ছিলেন সিংহের মত সাহসী বীর। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের মুকাবিলায় তার পক্ষে ময়দানে টিকে থাকা সম্ভব হল না। কুফাবাসী প্রতিটি সৈনিকের কামনা ছিল সে ছাড়া অন্য কেউ হুসাইনকে হত্যা করে ফেলুক। যাতে তার হাত রাসূলের দৌহিত্রের রক্তে রঙ্গিন না হয়। পরিশেষে নিকৃষ্ট এক ব্যক্তি হুসাইনকে হত্যার জন্য উদ্যত হয়। তার নাম ছিল শামির ইবন যুল জাওশান। সে বর্শা দিয়ে হুসাইনের শরীরে আঘাত করে ধরাশায়ী করে ফেলল। অতঃপর ইয়াযীদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে তিনি শাহাদাত অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করেন।
বলা হয় এই শামিরই হুসাইনের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কেউ কেই বলেন: সিনান ইবন আনাস আন্ নাখঈ নামক এক ব্যক্তি তাঁর মাথা দেহ থেকে আলাদা করে। আল্লাহই ভাল জানেন।

৩) ফুরাত নদীর পানি পান করা থেকে বিরত রাখার কিচ্ছা:
বেশ কিছু গ্রন্থ তাকে ফুরাত নদীর পানি পান করা থেকে বিরত রাখার ঘটনা বর্ণনা করে থাকে। আর বলা হয় যেতিনি পানির পিপাসায় মারা যান। এ ছাড়াও আরও অনেক কথা বলে মানুষকে আবেগময় করে যুগে যুগে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে এবং মূল সত্যটি উপলব্ধি করতে তাদেরকে বিরত রাখার হীন ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ সব কাল্পনিক গল্পের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। ঘটনার যতটুকু সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে আমাদের জন্য ততটুকুই যথেষ্ট। কোনো সন্দেহ নেই যেকারবালার প্রান্তরে হুসাইন নিহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ধ্বংস হোক হুসাইনের হত্যাকারীগণ! ধ্বংস হোক হুসাইনের হত্যায় সহযোগীরা! আল্লাহর ক্রোধ তাদেরকে ঘেরাও করুক। আল্লাহ্‌ তাআলা রাসূলের দৌহিত্র শহীদ হুসাইন এবং তাঁর সাথীদেরকে আল্লাহ তাআলা স্বীয় রহমত ও সন্তুষ্টি দ্বারা আচ্ছাদিত করুক।

৪) কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের সাথে আরও যারা নিহত হয়েছেন:
• আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সন্তানদের মধ্যে থেকে আবু বকরমুহাম্মাদউসমানজাফর এবং আব্বাস।
• সাইনের সন্তানদের মধ্যে হতে আবু বকরউমরউসমানআলী আকবার এবং আব্দুল্লাহ।
• হাসানের সন্তানদের মধ্যে হতে আবু বকরউমরআব্দুল্লাহ এবং কাসেম।
• আকীলের সন্তানদের মধ্যে হতে জাফরআব্দুর রাহমান এবং আব্দুল্লাহ ইবন মুসলিম ইবন আকীল।
• আব্দুল্লাহ ইবন জাফরের সন্তানদের মধ্যে হতে আউন এবং আব্দুল্লাহ। ইতপূর্বে উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদের নির্দেশে মুসলিম ইবন আকীলকে হত্যা করা হয়। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হোন। আমীন

৫) কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত ধারণা ঠিক নয়:
হুসাইন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুতে আকাশ থেকে রক্তের বৃষ্টি হওয়াসেখানের কোনো পাথর উঠালেই তার নীচ থেকে রক্ত প্রবাহিত হওয়া এবং কোনো উট জবাই করলেই তা রক্তে পরিণত হয়ে যাওয়ার ধারণা মিথ্যা ও বানোয়াট। মুসলিমদের আবে ও অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলে তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এ সমস্ত বানোয়াট ঘটনা বলা হয়ে থাকে। এগুলোর কোনো সহীহ সনদ নেই।
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন: হুসাইনের মৃত্যুর ঘটনায় লোকেরা উল্লেখ করে থাকে যেসে দিন কোনো পাথর উল্টালেই রক্ত বের হতসে দিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিলআকাশের দিগন্ত লাল হয়ে গিয়েছিল এবং আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হয়েছিল। এসব কথা সন্দেহমূলক। প্রকৃতকথা হচ্ছেএগুলো বিশেষ একটি গোষ্ঠীর বানোয়াট ও মিথ্যা কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা বিষয়টিকে বড় করার জন্য এগুলো রচনা করেছে।
কোন সন্দেহ নেই যেকারবালার ময়দানে সপরিবারে হুসাইনের শাহাদাতবরণ একটি বিরাট ঘটনা। কিন্তু তারা এটিকে কেন্দ্র করে যে মিথ্যা রচনা করেছেতার কোনটিই সংঘটিত হয় নি।
ইসলামের ইতিহাসে হুসাইনের মৃত্যুর চেয়ে অধিক ভয়াবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সে সমস্ত ঘটনায় উপরোক্ত বিষয়গুলোর কোনটিই সংঘটিত হয় নি। হুসাইনের পিতা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু আব্দুর রাহমান ইবন মুলজিম খারেজীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। সকল আলেমের ঐকমত্যে হুসাইনের চেয়ে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু অধিক শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত ছিলেন। তার শাহাদাতের দিন কোনো পাথর উল্টালেই রক্ত বের হয় নিসে দিন সূর্যগ্রহণ হয় নিআকাশের দিগন্ত লাল হয়ে যায় নি এবং আকাশ থেকে পাথরও বর্ষিত হওয়ারও কোনো প্রমাণ নেই।
উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়ি ঘেরাও করে বিদ্রোহীরা তাঁকে হত্যা করে। তিনি মজলুম অবস্থায় শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে এসবের কোনটিই সংঘটিত হয় নি। উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর পূর্বে খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাব ফজরের নামাযে দাঁড়ানোর সময় নির্মমভাবে নিহত হন। এই ঘটনায় মুসলিমগণ এমন মুসীবতে পড়েছিলেনযা ইতোপূর্বে কখনও পড়েন নি। তাতে উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা যায় নি।
আল্লাহর সর্বশেষ্ঠ বান্দা সমগ্র নবী-রাসূলের সরদার রাহমাতুল লিল আলামীন মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে এমন কিছু সংঘটিত হয় নি। যেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিশু পুত্র ইবরাহীম মৃত্যুবরণ করেনসেদিন সূর্যগ্রহণ লেগেছিল। লোকেরা বলতে লাগল: ইবরাহীমের মৃত্যুতে আজ সূর্যগ্রহণ হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্যগ্রহণের নামায আদায় করলেন এবং খুতবা প্রদান করলেন। খুতবায় তিনি বর্ণনা করলেন যেসূর্য এবং চন্দ্র কারও মৃত্যু বা জন্ম গ্রহণের কারণে আলোহীন হয় না। এগুলো আল্লাহর নিদর্শন। তিনি এগুলোর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদেরকে ভয় দেখিয়ে থাকেন।

৬) হুসাইনের বের হওয়া ন্যায় সংগত ছিল কি?
বিজ্ঞ সাহাবীদের মতে কুফার উদ্দেশ্যে হুসাইনের বের হওয়াতে কল্যাণের কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় নি। এ জন্যই অনেক সাহাবী তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছেন এবং তাঁকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি বিরত হন নি। কুফায় যাওয়ার কারণেই ঐ সমস্ত জালেম ও স্বৈরাচারেরা রাসূলের দৌহিত্রকে শহীদ করতে সক্ষম হয়েছিল। তার বের হওয়া এবং নিহত হওয়াতে যে পরিমাণ ফিতনা ও ফসাদ সৃষ্টি হয়েছিলমদিনায় অবস্থান করলে তা হওয়ার ছিল না। কিন্তু মানুষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালা ও তকদীরের লিখন বাস্তবে পরিণত হওয়া ছাড়া ভিন্ন কোনো উপায় ছিল না। হুসাইনের হত্যায় বিরাট বড় অন্যায় সংঘটিত হয়েছেকিন্তু তা নবীদের হত্যার চেয়ে অধিক ভয়াবহ ছিল না। আল্লাহর নবী ইয়াহ-ইয়া আলাইহিস সালামকে পাপিষ্ঠরা হত্যা করেছে। জাকারিয়া আলাইহিস সালামকেও তাঁর জাতির লোকেরা নির্মমভাবে শহীদ করেছে। এমনি আরও অনেক নবীকে বনী ইসরাইলরা কতল করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
﴿قُلۡ قَدۡ جَآءَكُمۡ رُسُلٞ مِّن قَبۡلِي بِٱلۡبَيِّنَٰتِ وَبِٱلَّذِي قُلۡتُمۡ فَلِمَ قَتَلۡتُمُوهُمۡ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١٨٣ ﴾ [ال عمران: ١٨٣] 
তুমি তাদের বলে দাওতোমাদের মাঝে আমার পূর্বে বহু রসূল নিদর্শনসমূহ এবং তোমরা যা আবদার করেছ তা নিয়ে এসেছিলেনতখন তোমরা কেন তাদেরকে হত্যা করলে যদি তোমরা সত্য হয়ে থাক।” (সূরা আল-ইমরান: ১৮৩)
এমনভাবে উমরউসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকেও হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং তাঁর হত্যা কাণ্ড নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করার কোনো যুক্তি নেই।

৭) কারবালার ঘটনাকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব?
যে মুসলিম আল্লাহকে ভয় করে তার জন্য হুসাইনের নিহত হওয়ার ঘটনা স্মরণ করে বিলাপ করাশরীর জখম করাগালমাথা ও বুক থাবড়ানো বা এ রকম অন্য কিছু করা জায়েয নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«ليس منا من لطم الخدود و شق الجيوب»
যে ব্যক্তি মুসীবতে পড়ে নিজ গালে চপেটাঘাত করল এবং শরীরের কাপড় ছিঁড়লসে আমাদের দলের নয়।” (বুখারী)
তিনি আরও বলেন: মুসীবতে পড়ে বিলাপকারীমাথা মুণ্ডনকারী এবং কাপড় ও শরীর কর্তনকারীর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: 
«إن النائحة إذا لم تتب فإنها تلبس يوم القيامة درعاً من جرب و سربالاً من قطران»

*

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

Recent Posts