বাদশা আকবরের শিকারের ভীষণ নেশা ছিল। রাজকার্জের অবসরে তিনি অনেককে নিয়ে শিকার করতে বের হতেন। এমনি একদিন শিকার করতে বেরিয়ে গভীর বনের মধ্যে ঢুকে পড়লেন, কিন্তু একটিও শিকার পেলেন না। শিকার খুঁজতে গিয়ে বাদশার সঙ্গীরা সকলেই একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বাদশারও খুব তেষ্টা পেয়েছিল। তিনি বললেন, এই গভীর বনের মধ্যে জলের চেষ্টা না করে চলো বন থেকে বেরিয়ে কোনও গ্রামে যাওয়া যাক, সেখানে নিশ্চয়ই জল পাওয়া যাবে।
বন থেকে বেরিয়ে কিছুটা যেতেই বাদশা দেখলেন একটি অল্পবয়সী ছেলে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে যাচ্ছে। বাদশা বুঝলেন কাছেই কোনও গ্রাম আছে। তিনি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বালক,এখানে কাছে পিঠে কোনও জলাশয় আছে?’ বালক বলল, ‘হ্যাঁ আছে ওই যে প্রকাও বটগাছটা দেখছেন, ওর পাশেই প্রকাও একটা জলাশয় আছে, খুব ঠাণ্ড জল। ওখানে জল খেয়ে গাছের নীচে বিশ্রামও করতে পারবেন। আকবর ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে খুব সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে তার ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পথ চলতে লাগলেন। পথ চলতে চলতে বাদশা জিজ্ঞেস করলেন, . ‘তোমার নাম কী ?’
আমার নাম জেনে আপনার কী লাভ বলুন ? তা আপনার নামটাই না হয় আগে শুনি ?
বাদশা ছেলেটির কাছ থেকে এই ধরনের উত্তর আশা করেননি, আর এই ধরনের বেয়াদপি তিনি কখনও সহ্যও করেন না। কিন্তু তিনি মনের রাগ মনেই চেপে রেখে হাসি হাসি মুখে বললেন, তুমি কি জানো আমি কে?
ছেলেটি এই কথায় বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে বলল, ‘আপনি কে তা জেনে আমার কী লাভ বলুন? আপনি কি আমাদের গ্রামের পুরুতঠাকুরের নাম জানেন?’
বাদশা ছেলেটির চাতুরিতে মেতে উঠলেন। তিনি মৃদু হেসে বললেন, তা কী করে জানব বলো? আমি তো তোমাদের গ্রামের কাউকেই চিনি না।’
ছেলেটি সরলভাবে বলল, ‘আমারও ঠিক একই উত্তর। আপনাকে জানাও আমার পক্ষে সম্ভব না।’
বাদশা আকবর। সহস্ৰ লোকের মাঝখান থেকে একজন যোগ্য লোককে চিনে নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে বলেই তিনি আসমুদ্র হিমাচলের অধীশ্বর। জুহরি সব সময় জহর চেনেন।
অল্পক্ষণ কথা বলেই বাদশা বুঝলেন এই ছেলেটি অন্য সাধারণ দশটি ছেলের মতো নয়, এই ছেলেটি বিশেষ একজন। তিনি বালকের কথায় মুগ্ধ হলেন। তাকে আংটি দান করলেন। জলাশয়ের ধারে এসে বাদশা সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি বুঝলেন গ্রামের এই প্রকৃতির শোভার সঙ্গে কোনও কিছুরই তুলনা হয় না, এ অতুলনীয়। শিকারের সন্ধানে ক্লান্ত বাদশা এই সরোবরের জল পান করে যেন নতুন জীবন ফিরে পেলেন।
আংটির ওপর বাদশার ছাপ দেখেই বুদ্ধিমান ছেলেটির বুঝতে আর বাকি থাকল না ইনি কে? ছেলেটি সেলাম জানিয়ে বাদশার কাছ থেকে বিদায় নিল।
এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, সেই ছেলেটি আজ যুবক। পিতৃহীন ছেলেটি তার
কাকার কাছেই মানুষ হয়েছে। ভাইপোকে একদিন কাছে ডেকে কাকা বললেন, “বাবা মহেশ, তুমি এখন বড় হয়েছ, নিজের ভাগ্যকে প্রতিষ্ঠিত করার এই তো সময়। এই সময়কে বৃথা নষ্ট কোরো না। এখন যদি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারো তবে আমার অবর্তমানে তুমি খুব কষ্ট পাবে।’
মহেশ ছিল যেমন বুদ্ধিমান তেমনি বিনয়ী। সে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, আপনি আমাকে কী করতে বলেন কাকা ? আপনি যা বলবেন আমি সেইমতোই চলব।’
কাকা বললেন, ‘তুমি এই ছোট্ট গ্রামের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে বিদেশে যাও। সেখানে
লাভ হবে এবং সেই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে, তুমি মানুষের মতো মানুষ হবে। তোমার বুদ্ধি আছে, সৎপথে চললে তুমি জীবনে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।’ ,
কাকার ওই সৎ এবং সময়োচিত উপদেশ যেন যুবক মহেশের মনের দরজা খুলে দিল। অনেকদিন থেকেই মহেশ ভাবছিল গ্রামের এই জীবনের মধ্যে যেন কোনও বৈচিত্র্য নেই—নেই কোনও উচ্চাকাঙক্ষ পূরণের সুযোগ।
এই সময় বিশেষ করে মনে পড়ল বাদশা আকবরের সেই কথাগুলো। সে ভাবল, যে আংটিটি এত বছর অতি যত্ন করে রেখে দিয়েছি এখন তাকে কাজে লাগাতে হবে। আবার ভাবল, বাদশা এতবড় এক ব্যক্তিত্ব, তিনি কি আর সেই কথা বা সেই বালককে এতদিন পর মনে করে রেখেছেন?
যাইহোক, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাদশার সাক্ষাৎপ্রার্থী হবে মহেশ, এই স্থির করে একদিন যাত্রা করল দিল্লির উদ্দেশে।
অনেক পথকষ্ট সহ্য করে একদিন রাজধানী দিল্লিতে এসে উপস্থিত হল যুবক মহেশ।
অনেক খোঁজখবর নিয়ে বাদশা যখন দরবারে বসেন সেই সময় দ্বাররক্ষীকে আংটিটি দেখিয়ে দরবার-কক্ষে প্রবেশ করল। গ্রামের ছেলে মহেশের দরবারকক্ষের জলুস দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সে দেখল বহুমূল্যবান এক স্বর্ণসিংহাসনে বাদশা বসে আছেন, চারদিকে সব পাত্র-মিত্ররা সভার শোভা আর বৃদ্ধি করেছেন।
সেদিন বাদশা বেশ খুশ-মেজাজেই ছিলেন। তিনি পাত্র-মিত্রদের কাছে জানতে চাইলেন,‘এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর ফুল কোনটি ‘
পাত্ৰ-মিত্ররা একে একে প্রায় সব ফুলেরই নাম বলে ফেললেন। বাদশা সবাইকেই নিরাশ
করলেন।
মহেশ বলল, যুক্তিহীন কথার কোনও দামই নেই, বিশেষ করে জাঁহাপনার কাছে। যার গুণ আছে তাকেই আমরা সুন্দর বলি। কার্পাস ফুলের গুটি থেকে যে তন্তু পাওয়া যায় তা থেকেই তৈরি হয় জগদ্বিখ্যাত মসলিন আর স্ত্রীলোকদের নয়নমনোহরণকারী ওড়না। ময়ূরের ছড়ানো পেখমের যেমন সৌন্দর্যের তুলনা নেই সেইরূপ কার্পাসও মানুষকে যে আনন্দ দেয় তার তুলনা নেই।’
উত্তর শুনে বাদশা যুবকের পরিচয় জানতে চাইলেন।
যুবক অনুমতি নিয়ে এগিয়ে এসে বহু বছর আগের দেওয়া আংটিটি দেখাল এবং সমস্ত ঘটনা বাদশাকে বলল।
বাদশা খুশি হয়ে বললেন, ‘তুমি আমার কাছে এসে ঠিক কাজই করেছ, আজ থেকে তুমি হলে আমার অন্যতম সভাসদ। আমি আশা করব, তুমি আমার দেওয়া এই পদের মর্যাদা রাখবে।’
এই সেই থেকে মহেশের নাম হল বীরবল।