হজরত আদম আলাইহিস সালাম এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

 


হজরত জিবরাইল ও মিকাইল আলাইহিমা সালামকে আল্লাহ আদেশ করলেন। বললেন, ‘হে আমার ফেরেশতা জিবরাইল ও মিকাইল! পৃথিবীতে যাও তোমরা এবং মাটি নিয়ে এসো সেখান থেকে!

আল্লাহর আদেশ মতো পৃথিবীতে এলো হজরত জিবরাইল ও মিকাইল। মাটি নিতে এলো মাটির পৃথিবীতে।
মাটি নেওয়ার জন্য জমিনে কেবল হাত লাগালেন হজরত জিবরাইল। অমনি চিৎকার করে উঠলো জমিন। বললো, ‘না ভাই জিবরাইল! আমার মাটি নিয়ো না। আল্লাহর দোহাই দিচ্ছি আমার মাটি নিয়ো না হে ফেরেশতাদ্বয়।’
জমিনের করুন আর্তনাদে মন গলে গেল জিবরাইল ও মিকাইলের। খালি হাতে আসমানে ফিরে এলো তারা। আল্লাহর দরবারে গিয়ে জমিনের করুন আর্তনাদের কথা জানালো এবং প্রকাশ করলো নিজেদের অপারগতা।
আল্লাহ এবার অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। পৃথিবী থেকে মাটি সংগ্রহ করার জন্য অন্য ফেরেশতা মনোনীত করলেন তিনি। এবার পাঠালেন হজরত আজরাইল আলাইহিস সালামকে। কারণ তিনি জানেন, আজরাইলের দয়া-মায়া কম। জমিনের মায়া-কান্নায় মন গলবে না ওর।
হজরত আজরাইল আলাইহিস সালাম এলো পৃথিবীতে এবং মাটি সংগ্রহ করে আসমানে ফিরে গেল। কোনো প্রকার কোনো আর্তনাদ-ই কানে নিলো না আজরাইল। জমিনকে উল্টো বলে দিলো, ‘তোমার আর্তনাদ শুনে আমি তো আর আমার প্রভুর কথা অমান্য করতে পারি না।’
বন্ধুরা! মাটি সংগ্রহ করার গল্প শোনাচ্ছি তোমাদেরকে। আল্লাহর আদেশে পৃথিবী থেকে মাটি সংগ্রহ করেছিলো আজরাইল ফেরেশতা। কিন্তু তোমরা কি জানো, কিসের জন্য মাটি সংগ্রহ করেছিলো ফেরেশতারা? কেনই বা পৃথিবী থেকে মাটি সংগ্রহ করিয়েছিলেন আল্লাহ মহান? কি করেছিলেন তিনি ঐ মাটি দিয়ে?
জানো না, তাই না। না জানারই কথা।
চলো তাহলে এবার তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর জানাই। কেন আল্লাহ পৃথিবী থেকে মাটি নিয়েছিলেন এবং কি করেছিলেন সেই মাটি দিয়ে। চলো আর দেরি না করে সামনে চলি…

কেন আল্লাহ মাটি নিয়েছিলেন
আল্লাহর ইচ্ছা হলো, পৃথিবীর বুকে প্রতিনিধি পাঠাবেন। প্রথম প্রতিনিধি। প্রথম সৃষ্টি। পৃথিবীতে বসবাস করবে এবং আল্লাহর ইবাদত করবে যারা। পৃথিবী নামক রাজ্যে ‘রাজত্ব’ করবে তারা। প্রথম জাতি। প্রথম সম্প্রদায়। তারা না হবে জিন, না হবে ফেরেশতা- মাটির পৃথিবীর জন্য মাটির মানুষ তৈরি করবেন আল্লাহ মহান।
সব ফেরেশতাদের ডাকলেন তিনি। সমবেত ফেরেশতাদের লক্ষ্য করে ঘোষণা করলেন, ‘হে আমার ফেরেশতারা; শোন তোমরা! পৃথিবীতে আমি আমার প্রতিনিধি পাঠাবো।’
আল্লাহর ঘোষণা শুনে কোনো কথা বললো না ফেরেশতারা। চুপচাপ রইলো সবাই। পৃথিবীর বুকে পাঠানো জিন জাতির কথা স্মরণ হলো তাদের। তারা ভাবলো, এর আগে আল্লাহ জিন জাতিকেও পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কি ভয়ানক অন্যায়Ñঅঘটনই না ঘটিয়েছে জিনরা। অশান্তিÑহানাহানি-রক্তপাতে বিষিয়ে উঠেছিলো গোটা পৃথিবী। ভয়ংঙ্কর সব অতীত-ইতিহাসের কথা স্মরণ করে নেতামাপের কিছু ফেরেশতারা বললো, ‘হে আল্লাহ! সকল সিন্ধান্ত একমাত্রই আপনার। আপনার সিন্ধান্তের উপর আর কোনো সিন্ধান্ত নেই। আপনি কি পৃথিবীতে আবারও এমন কোনো জাতি প্রেরণ করতে চান, যারা পুনরায় রক্তপাত ঘটাবে? আবার সৃষ্টি করবে অশান্তি? অথচ আমরাই রয়েছি আপনার একান্ত অনুগত। আপনার নির্দেশ মতো আমরাই করছি আপনার ইবাদত। সব সময় আমরাই গাইছি আপনার প্রশংসা-গীত।
আল্লাহ ফেরেশতাদের কথা শুনে বললেন, ‘হে আমার ফেরেশতারা শোন! আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।’
নূরের তৈরি ফেরেশতারা নিশ্চুপ হয়ে গেলো। এক বাক্যে আল্লাহর ইচ্ছাকে মেনে নিলো সবাই। কারণ আল্লাহর একান্ত অনুগত সৃষ্টি তারা। আর এ কথাও তো সত্যি, আল্লাহ যা জানেন; তারা (ফেরেশতারা) তা জানে না।’
হলো তো বন্ধুরা! আল্লাহর মাটি সংগ্রহ করার কারণ জানা হলো তো এবার। পৃথিবী নামক রাজ্যে প্রতিনিধি প্রেরণ করার ইচ্ছায়, মানুষ বানানোর জন্য পৃথিবী থেকে মাটি সংগ্রহ করেছিলেন আল্লাহ মহান।
এবার চলো, মাটি দিয়ে হজরত আদম আলাইহিস সালামকে কীভাবে তৈরি করেছিলেন সে কথা জানি।

কুদরতি হাতে সৃষ্টি হলেন তিনি
হজরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার জন্য পৃথিবী থেকে মাটি সংগ্রহ করলেন আল্লাহ। মানুষ বানাবেন তিনি। মাটির তৈরি মানুষ। পৃথিবীর প্রথম মানুষ। প্রথম নবি। প্রথম প্রতিনিধি।
পৃথিবী থেকে সংগ্রহ করা মাটিকে একত্র করলেন আল্লাহ। বিভিন্ন প্রকার মাটিগুলোকে এক প্রকার আঠালো রূপ প্রদান করা হলো। এরপর রোদে শুকিয়ে কিছুটা শক্ত করা হলো। আল্লাহ এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আমি মানুষকে ছাঁচে ঢালা টনটনে মাটি দ্বারা তৈরি করেছি।’
এরপর কি হলো বন্ধুরা! এরপর আল্লাহ তাঁর নিজ কুদরতি হাতে হজরত আদমকে সৃষ্টি করলেন। সুন্দর একটি আকৃতিতে আদমকে সৃষ্টি করলেন তিনি। এভাবেই তৈরি হলেন হজরত আদম। তৈরি হলো পৃথিবীর প্রথম মানুষ। প্রথম নবি। প্রথম প্রতিনিধিÑ হজরত আদম আলাইহিস সালাম।
সৃষ্টি হলো হজরত আদম কিন্তু প্রাণ এলো না তাঁর দেহে। নি¯প্রাণ বসে রইলো একটি দেহ। একটি মাটির পুতুল। এরপর আল্লাহ হজরত আদমের দেহে ‘রূহ’ ফুকে দিলেন। রূহ-প্রাণ যোগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সচল হয়ে উঠলো হজরত আদম। সচল হলো একটি মাটির দেহ। একজন আদম আলাইহিস সালাম।
বন্ধুরা! ‘রূহ’ কি জিনিস তোমরা কি জানো? না জনারই কথা। রূহ সম্পর্কে এখন তোমাদের জানা না থাকাই স্বাভাবিক। বড় হলে এ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবে তোমরা। এখন শুধু আল্লাহর এই একটি কথা জানো এবং ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য মনে রাখোÑ আল্লাহ বলেছেন, ‘হে নবি (হজরত মুহাম্মাদ সা.)! আপনাকে ‘রূহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আপনি বলে দিন, ‘রূহ’ তোমার প্রতিপালকের একটি হুকুম।’ সুতরাং আমরা জানলাম ‘রূহ’ আল্লাহর একটি হুকুম বা আদেশ।
প্রাণ-পাখি ফুঁকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন হজরত আদম। উপস্থিত সকলের সামনে উঠে দাঁড়ালেন এবং চারদিকে তাকিয়ে কি যেন দেখতে লাগলেন। এমন সময় আদেশ করলেন আল্লাহ। প্রথম মানুষ হজরত আদমকে লক্ষ্য করে হুকুম করলেন আল্লাহ। বললেন, ‘হে আদম! ফেরেশতাদের কাছে যাও এবং সালাম করো তাদের। আর মনে রেখো, সালামের প্রতিটি বাক্য। কারণ এটাই হবে তোমার এবং তোমার ভবিষ্যত বংশধরদের অভিবাদন।’
আল্লাহর আদেশ মতো ফেরেশতাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন হজরত আদম এবং উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করে বললেন, আসসালামু আলাইকুমÑ শান্তি বর্ষিত হোক আপনাদের ওপর।
হজরত আদমের সালাম শুনে ফেরেশতারা উত্তর দিলো। সমবেত স্বরে তারা বললো, ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহÑ শান্তি বর্ষিত হোক আপনার ওপরও।
বন্ধুরা! আমরা মুসলমান। একে অপরকে সালাম দেওয়া আমাদের নবির সুন্নাত। কিন্তু সালাম যে কেবল আমাদের নবিজির সুন্নাত এমনটি কিন্তু নয় বন্ধুরা। সালাম বেহেশতি অভিবাদন। যে অভিবাদনের প্রচলন আদম সৃষ্টির সময় থেকে। চলো বন্ধুরা! আজ আমরা এমটা প্রতিজ্ঞা করিÑ এখন থেকে সবাই আমরা একে অপরকে সালাম দেবো, ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ এরপর অভিনব এক পদ্ধতির মাধ্যমে হজরত আদম আলাইহিস সালামকে ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ দান করলেন। সব ফেরেশতাদের সমবেত করলেন এবং কিছু বস্তু দেখিয়ে সেগুলোর নাম জানতে চাইলেন তিনি। বললেন, তোমরা কি কেউ আছো; এই বস্তুগুলোর নাম বলতে পারবে?
কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে থেকে ফেরেশতারা বললো, হে আমাদের প্রভু! হে আমাদের মালিক! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, এর বাহিরে আর কিছুই জানি না আমরা। অতিরিক্ত কোনো বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই আমাদের। নিশ্চয়ই আপনি সর্বজ্ঞানী। আর আমরা আপনার মুখাপেক্ষী।
এরপর হজরত আদম আলাইহিস সালামকে ডাকলেন আল্লাহ এবং সেই একই বস্তুগুলোর নাম জিজ্ঞাসা করলেন। হজরত আদম আলাইহিস সালাম এক এক করে সবগুলো বস্তুর নাম ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ বলতে শুরু করলেন। এরপর আল্লাহ ফেরেশতাদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমি কি তোমাদের বলিনি, আকাশ ও পৃথিবীর সব বিষয়-ই আমার জানা। তোমরা যা প্রকাশ করো এবং যা কিছু গোপন রাখোÑ সবই আমি জানি। আর অবশ্যই তোমরা যা জানো না, আমি তা জানি।’
হেরে গেলো ফেরেশতারা। জয়ী হলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম। হজরত আদম আলাইহিস সালামের কৃতিত্বে খুশি হলেন আল্লাহ। সন্তুষ্ট হয়ে সমবেত ফেরেশতাদের বললেন, ‘ আদমকে সেজদাহ করো তোমরা সবাই। সম্মান জানাও আমার সম্মানিত সৃষ্টিকে।’
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নত করলো ফেরেশতারা। সেজদাহ করলো সবাই আদমকে। এক বাক্যে মেনে নিলো আল্লাহর আদেশ। কিন্তু একি কাণ্ড! ইবলিশ দাঁড়িয়ে রইলো। হজরত আদম আলাইহিস সালামকে সেজদাহ না করেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। সবাই সেজদাহ করলো কিন্তু ইবলিশ করলো না। সবাই মানলো আল্লাহর আদেশ কিন্তু ইবলিশ মানলো না। এই প্রথম, সর্বপ্রথম ইবলিশের মাধ্যমে আসমানপাড়ায় আল্লাহর আদেশ অমান্য হলো। কী ভয়ানক ধৃষ্ঠতা!
দয়াময় প্রভু সীমাহীন দয়া তাঁর। অসীম তাঁর ধৈর্য। ইচ্ছা করলেই ইবলিশকে শাস্তি দিতে পারতেন সঙ্গে সঙ্গে। মুর্হূতের মাঝে ধ্বংস করে দিতে পারতেন ইবলিশকে। কিন্তু না, তিনি তা করলেন না। কোনো প্রকার রাগও হলেন না তিনি।
শান্তভাবে ইবলিশকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি ব্যাপার ইবলিশ! আদমকে সেজদাহ করলে না কেন তুমি?’
ইবলিশ গলায় বিরক্তির ভাব নিয়ে বললো, আমি কেন সেজদাহ করবো ওকে? আমি তো ওর থেকে উত্তম। ও আমার তুলনায় নিকৃষ্ট। আমাকে আপনি সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে আর ও সৃষ্টি হয়েছে মাটি থেকে। আমি জানি আগুনের গতি উর্ধগামি আর মাটির স্বভাব নিম্নগামি। সুতরাং আমি ওকে সেজদাহ করতে পারি না।
ইবলিশের অহংকার মাখা কথা শুনে রেগে গেলেন আল্লাহ। ভীষণ ‘গোসসা’ হলো তাঁর। ইবলিশের এতো বড় ধৃষ্ঠতা সহ্য করলেন না তিনি। অসন্তুষ্ট হয়ে ‘বিতাড়িত’ বলে অভিশাপ দিলেন এবং আরশে মহল্লা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘বের হয়ে যা এখান থেকে। পবিত্র এই স্থানে অহংকারীদের কোনো জায়গা নেই। বের হ শীঘ্রই। আজ থেকে বিতাড়িত শয়তান বলেই তোকে চিনবে সবাই। আজ থেকে তুই আমার অভিশাপগ্রস্থ বিতাড়িত শয়তান’।

জিন থেকে ফেরেশতা, ফেরেশতা থেকে শয়তান
বন্ধুরা! ইবলিশ সম্পর্কে তোমাদেরকে তো কিছুই বলা হলো না। ইবলিশ আসলে কে তাও তো জানানো হলো না তোমাদের। চলো তাহলে, এবার তোমাদের ইবলিশের কথা বলি।
নগণ্য একজন জিন থেকে ‘মুয়াল্লিমুল মালাইকাহ’ হয়ে উঠা এবং পরবর্তীতে আল্লাহর আদেশ অমান্য করা পর্যন্ত চমৎকার সব ঘটনা রয়েছে ইবলিশের জীবনে। চলো তাহলে, আর কথা না বড়িয়ে গল্পের পথে হাঁটি। ইবলিশ শয়তানের জীবনের গল্প…
একদম শুরু থেকেই বলছি তোমাদের। পৃথিবী সৃষ্টির শুরুর সময়। পৃথিবী সৃষ্টি করার অনেক আগেই আল্লাহ ফেরেশতা সৃষ্টি করলেন। আলাদা আলাদা কাজের জন্য আলাদা আলাদা ফেরেশতা। পৃথক পৃথক দায়িত্ব পালনের জন্য পৃথক পৃথক ফেরেশতা গোষ্ঠী। এরপর পৃথিবীর সৃষ্টি করলেন তিনি। পৃথিবী সৃষ্টি করলেন আল্লাহ কিন্তু সেখানে পাঠালেন না কোনো ফেরেশতা। প্রশ্ন থাকে; তাহলে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন কেন আল্লাহ? কাদের জন্য এই পৃথিবী? কারা হবে এখানকার বাসিন্দা?
ফেরেশতারা অনুমান করলো, আমাদেরকে যখন এখানে পাঠালেন না নিশ্চয়ই এটা অন্য কারো জন্য। পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ অন্য কারণে। কিন্তু কারা সেই অন্য কেউ? কি সেই অন্য কারণ?
এরপর আল্লাহ নতুন এক জাতি সৃষ্টি করলেন। নতুন এক সম্প্রদায়। সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির ‘জিন’ জাতি সৃষ্টি করলেন তিনি এবং সর্বপ্রথম তাদেরকেই পাঠালেন পৃথিবীতে। জিনরাই পৃথিবীর সর্বপ্রথম বাসিন্দা।
বন্ধুরা! একটি ভুল ধারনা ভেঙ্গে দেই। তোমরা অনেকই হয়তো জানো কিংবা শুনেছ যে, মানুষই পৃথিবীর সর্বপ্রথম বাসিন্দা। সর্বপ্রথম প্রেরিত জাতি। মানুষের আগে এই পৃথিবেিত আর কোনো জাতি আসেনি। নাহ, বন্ধুরা! আমাদের আগে পৃথিবীতে আরো একটি জাতি প্রেরণ করেছিলেন আল্লাহ এবং এখনও তাদের অস্তিত্ব রয়েছে এই পৃথিবীতে। আর তারা হলো জিন। আগুনের তৈরি জিন জাতি। তবে বন্ধুরা! ভূত-প্রেত আর জিন কিন্তু এক নয়। পৃথিবীতে ভূত-প্রেত কিংবা পিশাচ-পেতনির কোনো অস্তিত্ব নেই ঠিক কিন্তু জিনের আবাস রয়েছে।
আল্লাহ এই জিন জাতিকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন। পৃথিবীর কর্তৃত্ব দান করেছিলেন তাদের। পৃথিবীর প্রথম সম্প্রদায়। প্রথম জাতি। জিন জাতি। আগুনের তৈরি জিন। ধোয়াহীন আগুন থেকে যাদের সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ মহান।
পৃথিবীতে পাঠানোর সময় আল্লাহ জিনদের বলে দিলেন, ‘হে জিন জাতি! পৃথিবীর এই জীবন কেবলই তোমাদের আরাম-আয়েশ কিংবা ভোগ-বিলাসিতার স্থান নয়। সেখানে কিছু কাজ রয়েছে তোমাদের। রয়েছে কিছু পালনীয় দায়িত্ব। কিছু কর্তব্য। পৃথিবীর সব সম্পদ, সব সুখ উপভোগ করবে আর একমাত্র আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। আমার ইবাদতই হবে তোমাদের মূল কাজ। ইহজীবনের প্রধান দায়িত্ব।
আল্লাহর আদেশ মেনে, তাঁর কথায় রাজি হয়ে পৃথিবীতে এলো জিন জাতি। বসবাস শুরু করলো তারা। সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ আর নানা প্রকার কাজে-কর্মে কেটে যাচ্ছিল জিনদের দিন। জিকির-আজকার, সেজদাহ-তিলাওয়াত আর নানা প্রকার ইবাদতে-বন্দেগিতে পাড় হচ্ছিল জিনদের রাত। বেশ শান্তিতে কাটছিলো তাদের জীবন। ভালোই ছিলো সবাই। সব ছিলো ঠিকঠাক।
কিন্তু বেশি দিন চললো না এভাবে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন মতভেদ দেখা দিলো জিনদের মাঝে। শত্র“ হয়ে উঠলো একে অপরের। ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি আর খুন-খারাপি হয়ে দাঁড়ালো জিনদের নিত্যদিনের কাজ। ভুলে গেল তারা আল্লাহকে। ভুলে গেল আল্লাহর আদেশকে। নানা প্রকার অনৈতিকতায় চরম অবনতি ঘটলো এক সময়। খারাপ কাজ করা, মন্দ কাজের বিস্তার ঘটানোই মূল কাজ হলো জিন জাতির।
জিনদের এমন অবস্থা দেখে খুব রাগ হলেন আল্লাহ। ভালো হওয়ার জন্য, ভালো পথে ফিরে আসার জন্য বিভিন্ন সুযোগ দিলেন তিনি। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। কেউ ফিরে এলো না ভালো পথে। দিন দিন আরো খারাপ হলো পরিস্থিতি। অশভ্যতায় ছেয়ে গেল গোটা জিন সমাজ। রাগন্বিত হয়ে শাস্তি দেওয়ার সিন্ধান্ত নিলেন আল্লাহ। পথভ্রষ্ট জিন জাতিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আজাব পাঠালেন তিনি। ফেরেশতাদের আদেশ দিলেন, ‘ধ্বংস করে ফেলো ওদের। হত্যা করো সব জিনকে। বদকার জিন যারা।’ আল্লাহর আদেশে ফেরেশতারা পৃথিবীতে এলো এবং খুঁজে খুঁজে হত্যা করা শুরু করলো জিনদের। ফেরেশতাদের আঘাতে একে একে খতম হলো অসংখ্য জিন। গহিন জঙ্গলে লুকিয়ে পালালো কেউ কেউ।
খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ একটি বাচ্চা জিন সামনে পড়লো ফেরেশতাদের। শিশু জিনটিকেও মারার জন্য এগিয়ে গেল একজন ফেরেশতা। পরক্ষণেই অন্য একজন ফেরেশতা বাঁধা দিলো তাকে। বললো, ‘অবুঝ শিশু জিন। ও আর এমন কি দোষ করেছে। থাক, ওকে মেরো না।’
শিশু জিনটির প্রতি মায়া হলো সবার। সব ফেরেশতরা মিলে পরামর্শ করলো কি করা যায়? সবাই সম্মত হয়ে আসমানে নিয়ে এলো শিশু জিনটিকে এবং রেখে দিলো নিজেদের কাছে।
পৃথিবী থেকে কুঁড়িয়ে আনা শিশু জিনটির নাম ছিলো কি জানো বন্ধুরা! ওর নাম ছিলো ‘আজাজিল’। আরবি নাম।
আসমানেই থাকতে শুরু করলো আজাজিল। ফেরেশতাদের কাছে থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে শুরু করলো। আগুনের তৈরি জিন হলেও স্বভাব-চরিত্রে কিছুটা সদভাব দেখা যাচ্ছিলো ওর। ফেরেশতাদের চলাফেরার ভাব-ভঙ্গিমা আজাজিলের মাঝেও প্রভাব ফেললো। সারাক্ষণ আল্লাহর ইবাদত করতো আজাজিল। সামান্য থেকে সামান্য সময়ও প্রভুর ইবাদতহীন কাটতো না।
এভাবে কেটে গেল হাজার বছর। পাড় হলো লক্ষ লক্ষ দিন। আজাজিলের জীবন থেকে বিদায় নিলো প্রভুর ইবাদতমূখর হাজার হাজার দিন, হাজার হাজার রাত। আজাজিলের জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা এবং ইবাদতের প্রতি তার আগ্রহ দেখে খুশি হলেন আল্লাহ। সন্তুষ্ট হয়ে পদমর্যাদা বাড়িয়ে দিলেন তিনি। আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘সম্মান’ পুরস্কার পেয়ে আরো বেশি ইবাদত শুরু করলো আজাজিল। আরো অধিক পরিমাণে সময় কাটাতে লাগলো প্রভুর স্মরণে। সেজদায় সেজদায় কাটিয়ে দিলো হাজার বছর। আসমান ও জমিনের এমন কোনো স্থান বাকি রইলো না, যেখানে সেজদাহ করেনি আজাজিল। ইবাদত-বন্দেগির আধিক্য এবং ইলম-আমলের উন্নতির কারণে আরো বেশি পদমর্যাদা প্রাপ্ত হলো আল্লাহ মহানে পক্ষ থেকে। ‘মুয়াল্লিমুল মালাইকা’ উপাধি লাভ করলো এক সময়। আল্লাহ তাকে ফেরেশতাদের শিক্ষক হিসেবে মানোনায়ন প্রদান করলেন।
বন্ধুরা! শব্দটি আগেও একবার এসেছে। এখানেও আবার এলো। ‘মুয়াল্লিমুল মালাইকা’ শব্দটি খুব কঠিন লাগছে তাই না। একটু অপেক্ষা করো; এক্ষুণি নরম করে দিচ্ছি। সহজভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমাদের। ‘মুয়াল্লিম’ আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো শিক্ষক। খুব পরিচিত শব্দ তোমাদের তাই না! স্কুলের শিক্ষক, ঘরের শিক্ষক কিংবা কোচিংয়ের শিক্ষকÑ আরবি ভাষায় এদের সবাইকেই মুয়াল্লিম বলা হয়। আর ‘মালাইকা’ অর্থ ফেরেশতা। এটাও আরবি শব্দ। সব মিলে ‘মুয়াল্লিমুল মালাইকা’ অর্থ হলো ফেরেশতাদের শিক্ষক। তোমাদের বাসা কিংবা স্কুলের শিক্ষকের মতো বিভিন্ন বিষয়ে ফেরেশতাদের শিক্ষা প্রদান করেন যিনি। তিনিই হলেন ‘মুয়াল্লিমুল মালাইকা’।
ফেরেশতাদের শিক্ষক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলো আজাজিল। তাই তাকে ‘মুয়াল্লিমুল মালাইকা’ বলা হতো। বুঝলে বন্ধুরা আজাজিল প্রতিদিন আরশে আজিমে বসে ফেরেশতাদের ক্লাস নিতো। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো আর ফেরেশতারা তার আলোচনা মুগ্ধ হয়ে শুনতো। এই যাও! ‘আরশে আজিম’ কি তাও তো জানো না তোমরা। শোন তাহলে, আরশে আজিম হলো আসমানপাড়ার বিশেষ একটি স্থানের নাম।
বন্ধুরা! আমরা এতক্ষণ যে শিশু জিনটির কথা আলোচনা করলাম। জিন থেকে ‘মুয়াল্লিমুল মালাইকা’ হওয়ার কাহিনী শুনলামÑ সেই আজাজিলই আল্লাহর আদেশ অমান্য করলো। নিজেকে উত্তম দাবি করে সেজদাহ করলো না আদম আলাইহিস সালামকে। অহংকার করলো। কিন্তু তার এ অহংকার সহ্য করলেন না আল্লাহ। সামান্য এই অহংকারের কারণে হাজার বছরের ইবাদত-বন্দেগি ধ্বংস করে দিলেন। বিলিন করে দিলেন তার পদমর্যাদা। কারণ তিনি অহংকারীদের পছন্দ করেন না। অহংকার করা বা বড়ত্ব প্রকাশ করা একমাত্র আল্লাহর অধিকার। আল্লাহ বলেছেন, ‘বড়ত্ব আমার চাদর সুতরাং তোমরা কেউ অহংকার করো না। বড়ত্ব প্রকাশ করো না।’
তাই বলি বন্ধুরা! কেউ কখনো অহংকারী হয়ো না। ক্লাস, বাসা কিংবা তোমার এলাকার কারো সঙ্গে অহংকার কোরো না কখনো। তোমার ভালো কোনো বিষয় নিয়ে, কিংবা তোমাদের ভালো বাড়িটা অথবা ভালো গাড়িটা নিয়ে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে নিজের বড়ত্ব প্রকাশ করবে না কখনো। আল্লাহ অহংকারী এবং যারা বড়ত্ব প্রকাশ করে, তাদের পছন্দ করেন না।

ইবলিশের ওপেন চ্যালেঞ্জ
আল্লাহর সিন্ধান্তে ঢেড় চিন্তা পড়ে গেলো ইবলিশ। আগুনের তৈরি লাল মুখখানা বির্বণ হয়ে গেলো প্রভুর অভিশাপে। বিকৃত রূপ ধারণ করলো আকৃতিও। আফসোস হলো ইবলিশের। অহংকারের এই পরিণাম দেথে ভীত হলো সে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার জ্বলে উঠলো অহংকারের আগুনে। নিজে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। নাহ, হার মানতে রাজি না আমি। যে আদমের কারণে আজ আমি বিতাড়িত হলাম, সে আদমকে পথভ্রষ্ট করবোই আমি। আদম সন্তানদের বিপথগামী করাই হবে আমার বাকি জীবনের একমাত্র কাজ। তবে হ্যাঁ; এজন্য কিছু শক্তি চাই আমার। চাই কিছু সুযোগ ও অবকাশ।
এই ভেবে আল্লাহর দরবারে আরজ করলো ইবলিশ। বললো,
ইবলিশ : হে প্রভু! বিতাড়িত হওয়ার এই ক্ষণে আমার কিছু বলার আছে! কিছু চাওয়া আছে আমার!
আল্লাহ : অনুমতি দেওয়া হলো তোকে। বল, হে আমার অভিশাপগ্রস্থ ইবলিশ!
ইবলিশ : যে আদমের কারণে আমি আজ বিতাড়িত হলাম। যে আদমকে সেজদাহ না করার কারণে আমার সব ইবাদত-বন্দেগি ধ্বংস হয়ে গেলো, সেই আদম এবং আদমের সন্তানদের চিরদিন বিরোধিতা করতে চাই আমি আর এজন্য কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চাই। কেয়ামত পর্যন্ত বাচাঁর আয়ূ দান করুন আমাকে!
আল্লাহ : যা শয়তান, কেয়ামত পর্যন্ত বাচাঁর আয়ূ দান করা হলো তোকে।
ইবলিশ : শুনে রাখুন হে আমার রব! যে আদমের কারণে আমার এই দূর্দশা; আজ থেকে আমি তার শত্র“। প্রকাশ্য শত্র“। সারা জীবন আমি আদম ও আদম সন্তানদের কুপথে পরিচালিত করার কাজ করবো। এটাই আমার মূল কাজ এবং আপনি অধিকাংশ আদম সন্তানকেই আমার পথে দেখবেন।
আল্লাহ : এক্ষুণি বের হয়ে যা তুই শয়তান। আর ভালো করে শুনে রাখ তুই। মানুষের মধ্য থেকে যারা তোর অনুসারী হবে, ওদের দ্বারাই জাহান্নাম ভর্তি করবো আমি। আরো শোন, জাহান্নামের রয়েছে সাতটি দরজা; প্রতিটি দরজা দিয়ে আমি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর তোর অনুসারী মানুষদের প্রবেশ করাবো। আর যারা তোর ধোঁকায় পড়বে না বরং আমার বাতানো পথে চলবে; তাদের জন্য আমি সৃষ্টি করেছি জান্নাত। চিরসুখের স্থান জান্নাত।
আল্লাহর কথা শুনে বিদায় হলো ইবলিশ। প্রভুর পক্ষ থেকে অভিশাপগ্রস্থ শয়তান ইবলিশ। আর জান্নাতে প্রবেশ করলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম। বেহেশতের প্রথম মানব। প্রথম অভিসারী।

এতো সুখ, এতো সম্মান তবু কেন্ একা লাগে
আল্লাহর আদেশে জান্নাতে থাকা শুরু করলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম। মানুষ জাতির আদি পিতা। পৃথিবীর সব পুরুষ সব নারীর একমাত্র আদি উৎস। সব বংশের উৎসমূল। মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম।
জান্নাতের বাগানে একা একা ঘুরে বেড়ান হজরত আদম। কখনো বহমান নদীর তীরে। কখনো বা ফুলের বাগানে। কখনো ঝরনার শ্রোত নীড়ে। কখনো বা পাখির কলরবে। ঘুরে বেড়ান আর বিমোহিত হন তিনি। প্রভুর সৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হন আর শোকরিয়া জানান আল্লাহর দরবারে। হে আমার রব! হে আমার প্রতিপালক! কতোই না সুন্দর তোমার সৃষ্টি। কতোই না নিপুণ তোমার কৃষ্টি।
মাঝে মাঝে ফেরেশতাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় হয় হজরত আদমের। মোবারকবাদ জানায় ফেরেশতারা তাঁকে। এতো সুখ, এতো সম্মান হাজার হাজার হুর-পরি। নাজ-নেয়ামত। তবুও কেন জানি কিছুই ভালো লাগে না তাঁর। শুন্য শুন্য লাগে। খালি খালি মনে হয়। কোনো একটি জিনিসের অভাব অনুভব করেন তিনি। বড় একা একা লাগে…
হজরত আদম দেখলেন, জান্নাত ভরা হুর-পরি আর অসংখ্য ফেরেশতাÑ সবারই সঙ্গী আছে। কথা বলার মতো, একসাথে চলার মতো বন্ধু রয়েছে সবারই। কেবল তিনিই একাÑ সঙ্গীহীন। একমাত্র তারই কোনো বন্ধু নেই। কথা বলার মতো, একসঙ্গে চলার মতো কোনো সাথী নেই তাঁর। সবার জোড়া আছে, কেবল তাঁরই কোনো জোড়া নেই।
এতো সুখ, এতো শান্তি আর সম্মানÑ তবুও অশান্ত হজরত আদমের মন। তবুও বিষন্ন কাটে তাঁর দিনক্ষণ। কীসের এ অপূর্ণতা? কীসের অভাব হজরত আদম আলাইহিস সালামের?
নিজেকে নিজে শান্তনা দেয় হজরত আদম। মনে মনে বুঝ গ্রহণ করে। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। যেই আদম সেই আদমেই ফিরে আসেন তিনি। যেই শুন্যতা সেই শুন্যতাই ফিরে আসে বারবারÑ বড় একা একা লাগে।
কিছুই বুঝে উঠতে পরছেন না হজরত আদম। এতো বোঝাচ্ছেন তবুও মন তাঁর কথা শোনে না। কোনোভাবেই শান্তি ফিরছে না মনে। কোনো কিছুতেই প্রাণ পাচ্ছেন না। সুখ পাচ্ছেন না হজরত আদম আলাইহিস সালাম।

আল্লাহ-ই পাঠিয়েছেন আমাকে
সবই জানেন আল্লাহ। সবই বোঝেন তিনি। মন কী চায়, কী চায় নাÑ সব কিছুরই খবর আছে তাঁর কাছে। সব কিছুই জানেন তিনি।
হজরত আদম আলাইহিস সালামের চাহিদা বুঝলেন তিনি এবং তাঁর চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা নিলেন। যথাযথ ব্যবস্থা। কী ব্যবস্থা নিলেন? চলো বন্ধুরা সামনে পড়ে আমরা জেনে নেই আল্লাহ হজরত আদমের মন খারাপ থাকা এই সম্যসার কী সমাধান করলেন। কীসের মাধ্যমে খুশি করলেন হজরত আদমকে!
বাগানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একদিন কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম। ঘুম ঘুম ভাব এলো তাঁর। জান্নাতের বাগানের একটি পাথরে হেলান দিলেন আল্লাহ নবি এবং এক সময় ঘুমিয়ে পরলেন। গভীর ঘুমের কোলো আচ্ছাদিত হলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম।
আল্লাহ এই সুযোগে তাঁর কাজ শুরু করলেন। হজরত আদমের জন্য সঙ্গী সৃষ্টির কাজ। ঘুমের কোলো শুয়ে থাকা হজরত আদমের পাজরের হাঁড় খুলে নিলেন এবং সেই হাঁড় দিয়ে সৃষ্টি করলেন হজরত হাওয়াকে। সৃষ্টি হলেন হাওয়া। বিবি হাওয়া। প্রথম নারী, মানব জাতির প্রথম মাÑ হজরত হাওয়া আলাইহা সালাম।
হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন এবং তাঁকে বসিয়ে রাখলেন ঘুমন্ত আদমের পাশে।
কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙ্গলো হজরত আদমের। নিদ্রাভাবের সঙ্গে সঙ্গে কেটে গেল ক্লান্তিও। ঘুম ভেঙ্গে চোখ মেলে তাকালেন হজরত আদম। চোখ মেলে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। অপরূপ রূপ-সৌন্দর্য এবং মনকাড়া গঠন-সৌন্দর্যের অধিকারী একজন নারী বসে আছে তাঁর পাশে। এক পলক তাকিয়েই বিমোহিত হলেন হজরত আদম। চোখ তাঁর ছানাবড়া আকৃতি ধারণ করলো। এ কি দেখছেন তিনি!
চোখে চোখ পরতেই চোখ নামিয়ে নিলেন হাওয়া। হায় লজ্জা। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো হাওয়ার চেহারা। আরো মোহনীয় হয়ে উঠলো তাঁর রূপ। আরো বেশি আকর্ষিত হলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম।
হজরত আদমের চোখে ধাঁধা লেগে গেলো। মনে সৃষ্টি হলো বিষ্ময়। শত চেষ্ঠা করেও চোখ ফেরাতে পারছেন না তিনি।
মনে মনে ভাবলেন, কে এই নারী? কোথা থেকে এলো এখানে? কেনই বা এতোটা আপন লাগছে আমার? এতো রূপ, এতো যৌবন তাঁর অথচ এতোটা কাছে আমার! আমার দেখা সব হুর-পরিরাও…
এতোটা রূপ সে পেলো কোথায়? কে এই মোহনীয় রমনী? কে?
বিভিন্ন প্রশ্ন এসে হজরত আদমের মনে ঢেউ কাটে। ধীরে ধীরে হজরত আদম হাওয়াকে পাওয়ার পথে হাঁটে। রঙিন রঙিন স্বপ্ন এসে মনে তাঁর দোলা কাটে। হৃদয় নদীর তীরে আঁছড়ে পরে ভালোবাসার ঢেউ। অজানা এক ভুবনে হারিয়ে যান হজরত আদম আলাইহিস সালাম।
অধীর হয়ে উঠেন হজরত আদম। হাওয়াকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছায় আগ্রহী হয়ে উঠে তাঁর মন। আন্দোলিত হয়ে যায় হৃদয়। ব্যাকুল হয়…
আবেদন ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন হজরত আদম, কে তুমি হে রমনী? কি তোমার পরিচয়? কেনই বা এখানে এসেছো তুমি?
হজরত আদমের প্রশ্ন শুনে আরো সংকচিত হন হাওয়া। আরো বেশি লাজুক ভাব ফুটে ওঠে তাঁর চেহরায়। লজ্জা ভরা মুখ নিয়ে তিনি শুধু বলেন, আল্লাহ-ই পাঠিয়েছেন আমাকে। আমাকে পাঠিয়েছেন এখানে। পাঠিয়েছেন আপনার…
এতটুকু বলেই থেমে যান হজরত হাওয়া আলাইহাস সালাম। আর বলতে পারেন না কিছু। আর কথা আসে না লাজুক মুখে তাঁর।
হজরত হাওয়া আলাইহা সালামের কথায় খুশির বান ডাকে হজরত আদমের মনে। আনন্দ-সুখে ব্যাকুল হয়ে হাওয়াকে জড়িয়ে ধরতে আগ্রহী হন তিনি। ভালোবাসাময় আবেদন নিয়ে আরো কাছে চলে যান হজরত হাওয়ার। হাওয়াকে ধরবেন ধরবেন হঠাৎ প্রত্যাদেশ এলো। আল্লাহর প্রত্যাদেশ। ইরশাদ করলেন আল্লাহ মহান, ‘ক্ষ্যান্ত হও হে আদম। থামো তুমি। স্পর্শ করো না হাওয়াকে। বিয়ে করা ছাড়া ওকে ছুঁতে পরবে না তুমি। স্পর্শ করতে পারবে না। বিয়ে করা ছাড়া সম্পূর্ণ হারাম ও তোমার জন্য।

আদম-হাওয়ার বিয়ে…
জমকালে আয়োজন হলো। নানান সাজে সাজানোর হলো আরশ-মহল্লা। সাজানো হলো আসমানপাড়া। ফেরেশতারা এলো। হুর-পরিরা এলো। এলো সব আসমানবাসীরা। সবার উপস্থিতিতে বিয়ে হলো আদম ও হাওয়ার। প্রথম মানব আর প্রথম মানবীর বিয়ে। বাবা আদম ও বিবি হাওয়ার বিয়ে। সবাই আনন্দিত। সবাই খুশি।
শেষ হলো বিয়ে। সমাপ্ত হলো বিয়ের আয়োজন। একে একে সবাই ফিরে গেলো। চলে এলো ফেরেশতারা। বিদায় নিলো সব হুর-পরিরা। একান্তে বসে রইলেন আদম এবং হাওয়া। নতুন বউ। নতুন বর। প্রথম স্বামী। প্রথম স্ত্রী। হজরত আদম আলাইহিস সালাম এবং হজরত হাওয়া আলাইহাস সালাম।
শান্ত মনে একান্তে বসে আলাপ করছেন হজরত আদম। পাশে তাঁর নব বিবাহিত স্ত্রী হজরত হাওয়া। মন তাঁর তৃপ্ত। জীবনসঙ্গী হিসেবে হজরত হাওয়াকে পেয়ে পরিতৃপ্ত হজরত আদম। নব বিবাহিত স্ত্রী হাওয়াকে আলিঙ্গন করতে ব্যস্ত হলেন তিনি। কাছে গিয়ে হাতটি ধরলেন কেবল হঠাৎ আবার আল্লাহর ডাক এলো। আল্লাহ বললেন, ‘হে আদম! হাওয়াকে তুমি বিয়ে করেছো ঠিক কিন্তু এখনও সে তোমার জন্য সম্পূর্ণভাবে বৈধ নয়। হাওয়ার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগেই ‘মোহরানা’ পরিশোধ করতে হবে তোমাকে।’
আল্লাহর কথা শুনে হজরত আদম তো হতবাক। কি আদশে করলেন প্রভু, কিছুই তো বুঝলেন না তিনি। ‘মোহরানা’ এ আবার কি জিনিস? কীভাবেই বা আদায় করবেন তিনি এই ‘মোহরানা’?
কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পরছিলেন না তিনি। এদিকে মনও তাঁর ধৈর্য মানছিলো না। ‘মোহরানা’ আদায় করা নিয়ে বেশ চিন্তায় পরে গেলেন হজরত আদম। পৃথিবীর প্রথম মানুষÑ হজরত আদম আলাইহিস সালাম।
প্রভুর কাছে আরজ করলেন হজরত আদম। ‘মোহরানার’ কথা জানতে চাইলেন তিনি। বললেন, ‘হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! কি এই ‘মোহরানা’? কীভাবেই বা তা আদায় করবো আমি? কিছুই তো জানি না আমি এ বিষয়ে।
হজরত আদমের আরজ শুনে আল্লাহ উত্তর দিলেন। বললেন, ‘শোন হে আদম! আমার একজন প্রিয় নবি আছে। আমার প্রিয় বন্ধু তিনি। আমার প্রিয় সেই নবির শানে ‘দরুদ’ পাঠ করো। আমার প্রিয় বন্ধুর শানে ‘দরুদ’ পাঠ করাই তোমার জন্য হাওয়ার মোহরানা। ‘দরুদ’ পাঠ করলেই মোহরানা আদায় করা হয়ে যাবে।’
এরপর হজরত আদম কি করলেন জানো বন্ধুরা? আল্লাহর প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে ‘দরুদ’ পাঠ করলেন। ‘দরুদ’ পাঠ করলেন এবং সম্পূর্ণভাবে বৈধ করে নিলেন প্রিয়তম স্ত্রী হজরত হাওয়াকে।
বন্ধুরা! ‘মোহরানা’ সম্পর্কে তোমাদের অল্প কিছু কথা বলি। মুসলমানদের বিয়ের জন্য ‘মোহরানা’ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মোহরানা ছাড়া মুসলমানদের কোনো বিয়েই হয় না। ‘মোহরানা’ উর্দূ শব্দ বাংলায় এর অর্থ হয় উপহার। একজন পুরুষ এবং একজন নারীর মধ্যকার বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য ইসলাম স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে কিছু অর্থ উপহার দেওয়ার নিয়ম রেখেছে আর একেই পরিভাষায় ‘মোহরানা’ বা ‘মাহর’ বলা হয়। বুঝলে বন্ধুরা! আরো বুঝবে ইনশাআল্লাহ। আগে বড় হও কেমন!
আল্লাহর আদেশ মতো ‘মোহরানা’ আদায় করে প্রিয়তম স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হলেন হজরত আদম। জাপিত হলো প্রথম বাসর। প্রথম মানব ও প্রথম মানবীর প্রথম বাসর রাত। প্রথম স্বামী ও প্রথম স্ত্রীর প্রথম মিলন রাত। প্রেমময় সুখকর একটি রাত।
আল্লাহ হজরত আদম ও বিবি হওয়াকে জান্নাতে বসবাস করার অনুমতি দিলেন এবং বললেন, ‘হে আদম! তোমার জীবনসঙ্গীনী হাওয়াকে নিয়ে জান্নাতে বসবাস করো এবং উপভোগ করো সেখানকার সব নাজ-নেয়ামত। খাও। পান করো। ঘুরে বেড়াও যেখানে খুশি। কিন্তু সাবধান! একটি কাজ করবে না কখনো। ঐ যে গাছটি দেখছো, গন্ধম গাছ। ঐ গাছটির কাছেও যাবে না কখনো। সাবধান! ভুলেও কখনো ঐ গাছের ফল খাবে না তোমরা। খবরদার! ঐ গাছের কাছেও যেন না যাও তোমরা। যদি ঐ গাছের ফল খাও, জান্নাত থেকে বের করে দেবো তোমাদের। চিরদিনের জন্য বিতাড়িত হবে সুখের এই উদ্যান থেকে। মনে রেখো আদম, এই একটি কথা ভালোভাবে মনে রেখো জান্নাত জীবনে।
হজরত আদম এবং হজরত হাওয়া মন দিয়ে শুনলেন আল্লাহর কথা এবং মেনে নিলেন সন্তুষ্টচিত্তে। সুবোধ বালকের মতো বরণ করে নিলেন প্রভুর আদেশ এবং শান্তিতে বসবাস শুরু করলেন জান্নাতে।
শুরু হলো সংসার। প্রথম মানব ও প্রথম মানবীর সংসার। প্রথম স্বামী ও প্রথম স্ত্রীর সংসার। বাবা আদম ও বিবি হাওয়ার সংসার। আনন্দের বাগানে সুখের সংসার…

আদমের সুখ আমার তো আর সহ্য হয় না
শয়তান ইবলিশের তো এদিকে মাথায় হাত। বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতেই পরে রইলো। আর ঐদিকে আদম-হাওয়া সুখে-শান্তিতে দিন কাটাচ্ছে জান্নাতে। এ জ্বালা কিভাবে সহ্য হয়…
হিংসার আগুনে জ্বলে ছাই হচ্ছিলো ইবলিশের মন। ধীরে ধীরে আরো শক্ত হচ্ছিলো আদমকে ঠকানোর শয়তানি পণ। ইবলিশ ভাবলো, ‘নাহ, আর এভাবে বসে থাকা যায় না। একটা উপায় আমাকে বের করতেই হবে। আদমকে পরাজিত করতেই হবে আমাকে। আমার এই করূণ অবস্থার জন্য একমাত্র ও-ই দায়ি। পরাজিত ওকে করতেই হবে।
যত যাই ভাবে ইবলিশ, যত ফন্দিই করে, সবকিছুতে বাঁধা একটাইÑ জান্নাতে প্রবেশ করা। আদম থাকে জান্নাতে আর ইবলিশের বসবাস পৃথিবীতে। জান্নাতে প্রবেশ করা তার জন্য নিষেধ।
এরপর ইবলিশ কি করলো জানো বন্ধুরা! ইবলিশ খুব সাজু-গুজু করলো। আরে না বন্ধুরা! বেড়াতে যাওয়া জন্য সাজু-গুজু না, ফেরেশতাদের ধোঁকা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য সাজলো ইবলিশ। ফেরেশতাদের রূপ ধরলো সে। নকল ফেরেশতা সাজলো ইবলিশ।
নকল ফেরেশতা সেজে জান্নাতের দিকে রওনা হলো ইবলিশ। সাত আকাশ পাড়ি দিয়ে জান্নাতের দওজায় পৌঁছলো এবং অপেক্ষা করলো। জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য অপেক্ষা। পাহারাদার ফেরেশতাদের ধোঁকা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলো ইবলিশ।
যাই বলো বন্ধুরা! এই এখানে এসে ইবলিশ শয়তানের ধৈর্যের প্রশংসা না করে আর পরছি না। প্রতিটি মানুষের মাঝে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য এমন ধৈর্য থাকা একান্ত প্রয়োজন।
অনেক সময়, অনেক কাল অপেক্ষা করলো ইবলিশ। অপেক্ষা করলো এবং ধৈর্য ধারণ করলো। ধৈর্য ধরলো এবং সফল হলো। পাহারাদার ফেরেশতাদের ধোঁকা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করলো সে। জান্নাত থেকে বিতাড়িত ইবলিশ জান্নাতে প্রবেশ করলো আবার।
জান্নাতে প্রবেশ করে সোজা চলে গেলো সেই গাছের কাছে। কোন্ গাছ, মনে আছে তো বন্ধুরা! নিষিদ্ধ সেই গাছ। যে গাছের কাছে যেতে, যে গাছের ফল খেতে আদম ও হাওয়াকে নিষেধ করেছিলেন আল্লাহ।
ইবলিশ সোজা গিয়ে সেই গাছে উঠলো এবং সেখানেই থাকা শুরু করলো। আল্লাহর নিবেদিত একজন বান্দা হিসেবে গাছের নিচে বসে ইবাদত শুরু করলো। জোড়ে জোড়ে জপতে শুরু করলো আল্লাহর নাম। দেখে মনে হবে, আল্লাহ ভক্ত একজন সাধক। আল্লাহর ইবাদত আর তাঁর জিকির ছাড়া কিছুই বোঝেন না তিনি। সাধু বাবা সেজে গাছের নিচে অবস্থান করলো ইবলশি শয়তান।
এভাবে কেটে গেলো কিছুদিন। এভাবেই ধৈর্য ধরলো এবং নিজের উদ্দেশ্য সফল করার পথে সামনে এগুতে থাকলো ইবলিশ। লোক দেখানো ইবাদত করে সময় পাড় করলো ইবলিশ।
সময় কাটালো আর আদমকে ঠকানোর পথ খুঁজলো। কীভাবে এবং কোন পথে ধোঁকায় ফেলা যায় আদমকে?

চলো না দেখে আসি উনি কে
হঠাৎ একদিন দূর থেকে আদম ও হাওয়া লক্ষ্য করলো এই দৃশ্য। একান্তে বসে আল্লাহর ইবাদত করতে দেখলো ইবলিশকে। দেখে ভাবলো, কে এই ইবাদতকারী? নিষিদ্ধ গাছের নিচে বসে ইবাদত করছে? আগে তো কখনো দেখিনি তাকে…
চোখাচোখি হয় আদম হাওয়ার। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না তারা। জানার আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যায় নিষিদ্ধ সেই গাছের কাছে এবং জিজ্ঞেস করে হাওয়া, ‘কে আপনি হে সাধু পুরুষ? কোথা থেকে এসেছেন? কেনই বা নিষিদ্ধ এই গাছের নিচে বসে ইবাদত করছেন আপনি?
শয়তান খুব নম্র ভাষায় উত্তর দিতে শুরু করলো। ভদ্র ভাবে বললো, ‘আমিও তোমাদের মতো একজন আল্লাহর বান্দা। নগন্য গোলাম একজন আল্লাহর। আমি তোমাদের ভালো চাই। আমি তোমাদের উপকার করতে চাই। আমার কিছু কথা ছিলো তোমাদের সঙ্গে, তাই অনেকদিন ধরে বসে আছি এখানে, নিষিদ্ধ এই গাছের নিচে অপেক্ষা করছি। আমার এখানে আসা কেবল-ই তোমাদের জন্য’।
শয়তান ইবলিশের কথা শুনে আশ্চর্য হলেন আদম-হাওয়া। বিস্মিত হলেন তাঁরা। ভাবলেন এ আবার কেমন কথা। চিনি না, জানি না, তার আবার কি এমন কথা থাকতে পারে আমাদের সঙ্গে। কি এমন কথা যা বলার জন্য সে নিষিদ্ধ এই গাছের নিচে বসে আছে? এমনটা ভাবছেন আর একে অপরের দিকে তাকাছেন আদম ও হাওয়া।
আদম হাওয়ার ভাব দেখে শয়তান বললো, কি বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা তাই না। তোমরা ভাবছো, আমি বুঝি মিথ্যা বলছি তোমাদের। দেখো, আদম! আমাকে তোমরা এর আগে কখনো দেখোনি। আমিও তোমাদের কথা শুনেছি মাত্র আগে কখনো দেখিনি। একজন অপরিচিত মানুষ হিসেবে মিথ্যা বলে কি লাভ আমার?
শয়তানের কথায় কিছুটা মনযোগী হলো আদম ও হাওয়া। এ অবস্থা দেখে শয়তান আবার বলা শুরু করলো। শোন তাহলে, আমি আমার কথাগুলো তোমাদের বলে যাই। কারণ এটা আমার দায়িত্ব। বলার কাজ বলবো, ভালো মনে হলে রেখো আর মন্দ মনে হলে ধিক্কার দিয়ো আমাকে।
শয়তান : আমরা ফেরেশতা। আল্লাহর আরশ-কুরসির আশেপাশে থাকি আমরা। অনেক কথাই শুনতে পাই। অনেক গোপন কথাই জানি আমরা। কিন্তু বলতে পারি না ইচ্ছা থাকলেও।
শোন আদম! শোন হাওয়া! কিছুদিন আগের কথা। আল্লাহর আরশে মহল্লায় ছিলাম আমি। তখন আমি আল্লাহকে এ কথাটা বলতে শুনেছি। আমাদের কিছু ফেরেশতা ভাইদের বলেছেন, তিনি তোমাদের বেহেশত থেকে বের করে দিতে চান। পৃথিবী নামক একটি জগত তৈরি করেছেন তোমাদের জন্য। সেখানে পাঠাবেন তিনি তোমাদের। এমনটাই ইচ্ছা তাঁর। আমি তোমাদের খুব পছন্দ করি। তোমাদের এখান থেকে বের করে দেওয়ার কথা শুনে খুব খারাপ লাগছে আমার।
হজরত আদম ও হাওয়া প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলেন, ঠিক আছে আল্লাহর যদি ইচ্ছা হয় পৃথিবীতে রাখবেন আমাদের, তো আমরা সে সিন্ধান্তে রাজি আছি। চলে যাবো পৃথিবীতে। আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী চলাই আমাদের কাজ।
শয়তান এবার চেহারার মাঝে তাচ্ছিল্যে ভাব ফুটিয়ে বললো, পৃথিবী কি জিনিস জানো তোমরা? জানো না দেখেই এতো আগ্রহ দেখাচ্ছো। জান্নাতে থেকেছো তোমরা, এখানেই তোমাদের সৃষ্টিÑ পৃথিবীর অতো কষ্ট সহ্য করবে কীভাবে? পৃথিবীর কষ্টের কথা শুনলে ভুলেও আর নাম নিবে না ঐখানে যাওয়ার।
পৃথিবীর কষ্টের কথা শুনে ভয় পেলো হাওয়া। আগ্রহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ইবলিশকে, কি করতে হবে তাহলে আমাদের? কষ্টের পৃথিবীতে না যেতে চাইলে কি করতে হবে আমাদের, আপনি কি তা জানেন?
শয়তান ভাবলো সবেমাত্র টোপ গিলেছে হাওয়া। এবার গলায় বড়শি আটকানোর পালা। খুব শান্ত ভাবে, দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে বললো শয়তান, জানি গো জানি। না জানলে কি আর এখানে এসেছি। কিন্তু খুব ভয় হচ্ছে আমার। তোমাদের এ কথা জানানোর পর না জানি কি শাস্তি হয় আমার!
থাক তবুও বলছি, কারণ তোমাদের ভালো চাই আমি। তোমরা সুখে থাকো এটাই আমার কামনা।
এই যে গাছটা দেখছো; আমি বসে আছি যে গাছের নিচেÑ জানো এটা কি গাছ? এই গাছের ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো কিছু জানা আছে তোমাদের? অমরত্বদানকারী গাছ এটি। এই গাছের ফল মানুষকে স্থায়ী জীবন দান করে। যে একবার এই গাছের ফল খাবে চিরদিন বেঁচে থাকবে সে। কোনোদিন মৃত্যু হবে না তার এবং বেহেশতের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে। তোমাদেরকে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠাতে চান। এখানে রাখবেন না তিনি। তাই, তিনি এই গাছের কাছে আসতে তোমাদের নিষেধ করেছেন। ফল খেতে নিষেধ করেছেন। তোমরা যদি এই গাছের ফল খাও, জান্নাতের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে তোমরা। আল্লাহ এটা চান না। সুতরাং তোমরা যদি সব সময় জান্নাতে থাকতে চাও তাড়াতাড়ি এই গাছের ফল খাও।
এ কথা বলতে বলতে লাফ দিয়ে গাছে উঠে কয়েকটি ফল ছিঁড়ে খেতে শুরু করলো ইবলিশ। আর বলতে লাগলো, আহ! কি সুস্বাদু ফল। আহা! কি মাজাদার!
ইবলিশের মন ভোলানো কথায় ধোঁকায় পরে গেলো আদম-হাওয়া। বেহেশতে থাকার মায়ায় ধরলো তাঁদের। তারা ভাবলো, কথা তো সত্যি; আমরাও তো চিরদিন বেহেশতে থাকতে চাই। আর বেহেশতে থাকা মানেই আল্লাহর কাছাকাছি থাকা।
আদম-হাওয়া আরো ভাবলো, আমরা যদি এই ফল খাই। আর আল্লাহ যদি আমাদের ফল খাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। বলবো, আমরা শুনেছি এই ফল খেলে চিরদিন জান্নাতে থাকা যায়। আর জান্নাতে থাকা মানে আপনার কাছাকাছি থাকা। আপনার কাছাকাছি থাকার জন্য আমরা এই ফল খেয়েছি।
এই ভেবে প্রথম হাওয়া খেলেন কয়েকটি ফল। এরপর হাওয়ার অনুরোধে একটি ফল খেলেন হজরত আদমও।

খুশি হলো শয়তান, রাগ হলেন আল্লাহ
কিন্তু একি! একি সর্বনাশ হলো
হায়! হায়!
ফল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবরণহীন হয়ে পরলো আদম-হাওয়া। গায়ের পোশাক খসে পরলো তাঁদের। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গেলো বাবা আদম এবং বিবি হাওয়া। লজ্জিত হলেন একে অপরের দিকে তাকিয়ে। কি অপমান! কি লজ্জাকর অবস্থা!
কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তাঁরা। কেন এমন হচ্ছে? কি কারণ? কিছুই বুঝতে পারছেন না। অস্থির হয়ে উঠলো দেহ-মন। ভয়ে-শঙ্কায় দৌঁড়াতে লাগলেন এদিক ঐদিক। বেহেশতি গাছের লতা-পাতা ছিঁড়ে ঢাকার চেষ্টা করলেন শরীর-লজ্জাস্থান। কিন্তু না, তাও পারলেন না। কোনো লাভ হলো না কিছুতেই। শরীর থেকে গলে পরে যাচ্ছিল লতা-পাতাও। কি হচ্ছে এসব! কি কারণ এমন পরিনতির। কিছু না বুঝে কেবল দৌঁড়াচ্ছেন আর দৌঁড়াচ্ছেন। কখনো ডানে। কখনো বা বামে। কখনো সামনে। কখনো বা পিছনে। ভয়ানক অবস্থা।
ভয়-লজ্জা আর শাস্তির চিন্তায় চিৎকার শুরু করলেন হজরত আদম। চিৎকার শুরু করলেন হাওয়াও। আদম-হাওয়ার কান্না আর চিৎকারে ভারি হয়ে উঠলো চারিদিক। থমথমে হয়ে গেল বেহেশতের পরিবেশ।
হঠাৎ আল্লাহর প্রত্যাদেশ এলো। কথা বললেন আল্লাহ। আদম-হাওয়াকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদের ঐ গাছের ব্যাপারে আগেই সর্তক করিনি। আমি কি তোমাদের বলিনি, শয়তান তোমাদের শত্র“। প্রকাশ্য শত্র“।’
আল্লাহর কথা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন আদম। কেঁদে উঠলেন হাওয়া। চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন দুজনেই। কান্নাভরা কণ্ঠে আরজ করলেন, ‘হে আমাদের প্রভু! হে মালিক! অপরাধ করেছি আমরা। অপরাধী আমরা। নিজেরাই ডেকে এনেছি নিজেদের বিপদ। নিজেদের সর্বনাশ। হে মালিক! আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন, ধ্বংস হয়ে যাবো আমরা। যদি আপনি দয়া না করনে, শেষ হয়ে যাবো আমরা। আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। দয়া করুন প্রভু। ক্ষমা করুন আমাদের।

শুরু হলো পৃথিবী জীবন…
হজরত আদম ও হাওয়ার আকুতি-মিনতি শুনে আল্লাহ বললেন, যাও তোমরা আর বেহেশতে বাস করতে পারবে না। এই মুহূর্তে বের হয়ে যাও আমার বেহেশত থেকে এবং চলে যাও ঐ দুনিয়াতে। সেখানে গিয়ে বসবাস করো। তোমরা এবং তোমাদের সন্তানরা সেখানেই বসবাস করবে। সেখানেই জীবন যাপন করবে। পৃথিবীতে তোমাদের বংশধরদের মাঝে কেউ কেউ একে অপরের শত্র“ হবে এবং সেখানেই রয়েছে তোমাদের আহার ও বসবাসের স্থান। পৃথিবীতে অল্প কিছুদিন বেঁচে থাকবে তোমরা। সেখানে থেকে বেহেশতের জন্য চেষ্ঠা করো। আবার মৃত্যু হবে এবং হাশরের দিন পুনরায় জীবিত করা হবে তোমাদের কাজের হিসাব নেওয়ার জন্য। অতপর স্ব স্ব কর্মফল অনুযায়ী কাউকে বেহেশেত এবং কাউকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। মনে রেখো, পৃথিবী তোমাদের জন্য একটি পরীক্ষার স্থান।’
আদম ও হাওয়ার কথা শুনলেন আল্লাহ। কথা শুনলেন কিন্তু জান্নাতে থাকার অনুমতি দিলেন না আর। পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন তাঁদের।
পৃথিবীতে এলেন হজরত আদম। এলেন হজরত হাওয়াও। কিন্তু একি কাণ্ড! কোথায় নামলেন হাওয়া! কোথায় নামলেন আদম। পৃথিবীতে নামার পর একে অপরকে খুঁজে পেলেন না আদম-হাওয়া। হজরত আদম দেখলেন প্রিয়তমা স্ত্রী নেই তাঁর পাশে। হজরত হাওয়া দেখলেন প্রিয়তম স্বামী নেই তাঁর পাশে। বিষন্ন হয়ে গেলো আদম ও হাওয়ার মন। কেঁদে উঠলেন নবি। কেঁদে ফেললেন হাওয়াও। একে তো প্রভুর অসন্তুষ্টি অন্যদিকে প্রিয়জন হারানোর ব্যাথাÑ এও কি সহ্য করা যায়।
কেঁদে কেঁদে বুক ভাসালেন হজরত আদম। কেঁদে কেঁদে বুক ভাসালেন হজরত হাওয়া। প্রভুর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন দুজনেই। ফিরে চাইলেন একে অপরকে।
অনুতপ্ত হয়ে দোয়া করলেন আল্লাহর দরবারে। ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। আপনি যদি আমাদের মাফ না করেন, দয়া না করেন আমাদের প্রতিÑ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবো আমরা। ক্ষমা করুন প্রভু! দয়া করুন আমাদের ওপর!
অনুতপ্ত হয়ে কাঁদলেন হজরত আদম। কাঁদলেন হজরত হাওয়া। কেঁদে কেঁদে বুক ভাসালেন দুজনেই। প্রার্থনা করলেন প্রভুর কাছে। ক্ষমা চাইলেন। চাইলেন প্রভুর মার্জনা।
দোয়ায় দোয়ায় কেটে গেলো অনেক দিন। প্রার্থনা প্রার্থনায় বিদায় নিলো অনেক রাত। তবু থামলেন না আদম। থামলেন না হাওয়া।
অনেক কিছু বলে বলে ক্ষমা চাইলেন। অনেক কিছুর ওয়াদা করলেন কিন্তু কোনো কাজ হলো না। এরপর একদিন কি করলেন হজরত আদম জানো বন্ধুরা! হজরত আদমের মনে পরলো আল্লাহর বন্ধুর কথা। হজরত আদমের মনে পরলো, বিয়ের সময় আল্লাহ মহার তাঁর বন্ধুর নামে ‘দরুদ’ পাঠ করতে বলেছিলেন।
এ কথা মনে করে আল্লাহর ঐ বন্ধুর উসিলা দিয়ে ক্ষমা চাইলেন হজরত আদম। ক্ষমা চাইলেন এবং এবার তাঁর প্রার্থনা কবুল হলো।
খুশি হয়ে আল্লাহ হজরত জিবরাইলকে বলে পাঠালেন, হে জিবরাইল! তুমি আমার বান্দা আদমকে গিয়ে বলো আমার বন্ধুর উসিলা গ্রহণ করার কারণে কবুল করেছি আমি তার দোয়া। ক্ষমা করেছি তাঁকে এবং হাওয়াকে। আদমকে বলো; সে যেন মক্কায় গিয়ে হজ আদায় করে’।
সঙ্গে সঙ্গে চলে এলেন হজরত জিবরাইল। হজরত আদমকে জানালেন আল্লাহর কথা। বললেন, হে আদম! আল্লাহর বন্ধুর উসিলা দিয়ে দোয়া করার কারণে আল্লাহ তোমাকে ও হাওয়াকে ক্ষমা করেছেন এবং পবিত্র মক্কায় গিয়ে হজ পালন করার আদেশ দিয়েছেন।
খুশি হলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম। প্রভুর দয়ায় শুকরিয়া জানাতে সেজদায় লুটিয়ে পরলেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন আল্লাহর দরবারে এবং সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা দিলেন মক্কার উদ্দেশ্যে।

ফিরে পেলেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে
ঐতিহাসিকদের মতে, আসমান থেকে বর্তমান শ্রীলঙ্কার সরন্দীপে নামানো হয়েছিলো হজরত আদম আলাইহিস সালামকে এবং বিবি হাওয়াকে নামানো হয়েছিলো জেদ্দায়।
সরন্দীপ থেকে মক্কাÑ অনেক দূরের পথ কিন্তু মক্কায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না হজরত আদমের। আল্লাহর কুদরতে মাত্র ত্রিশ পা হেঁটেই পৌঁছে গেলেন মক্কায়। মক্কায় এসে দেখলেন হাজার হাজার ফেরেশতা উপস্থিত সেখানে। হজরত আদম আলাইহিস সালামের আগমনে শুভেচ্ছা জানালো ফেরেশতারা এবং বললো, হে আদম! আসসালামু আলাইকুম! আমরা এখানে প্রায় দুই হাজার বছর যাবত ‘আল্লাহর ঘর’ তাওয়াফ করছি।
বন্ধুরা! সৌদি আরবের মক্কায় অবস্থিত বর্তমান ‘আল্লাহর ঘর’ তখন কিন্তু এমন ছিলো না। এমনভাবে সাজানো, এমন জমকালো ছিলো না। এমন কি তখন সেখানে কোনো ঘরও ছিলো না। আল্লাহর আদেশে ফেরেশতারা নির্দিষ্ট একটি স্থানে সংরক্ষণ করে রেখেছিলে।
মক্কার এই স্থানটিকে ‘বায়তুল্লাহ’র জন্য নির্বাচিত করার কারণ জানো বন্ধুরা? জানো না নিশ্চয়ই। চলো এবার জানি। মক্কার যে স্থানটিতে বায়তুল্লাহ অবস্থিত সে স্থানটি গোটা পৃথিবীর মধ্যস্থান। এই স্থানের বরাবর উপরে চর্তুথ কিংবা সপ্তম আসমানে ফেরেশতাদের মসজিদ অবস্থিত। যার নাম বায়তুল মামুর।
ফেরেশতাদের সঙ্গে কথা বলে কিছুটা দূরে এসে বসলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম। বর্তমান আরাফাতের ময়দানের পাশে ‘রহমত’ নামক পাহাড়ে এসে বসলেন তিনি। শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচন্ড দূর্বল হয়ে পরেছিলেন আল্লাহর নবি।
হঠাৎ মনে পরলো তাঁর স্ত্রীর কথা। প্রিয়তম স্ত্রীর বিরহ আঘাত করলো হৃদয়ে। কেঁদে উঠলো নবির মন। সঙ্গে সঙ্গে বসে পরলেন তিনি। আল্লাহর দরবারে আবার প্রার্থনা শুরু করলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম। ক্লান্ত শরীর বিষন্ন মনে আর কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে ফরিয়াদ জানালেন আল্লাহর কাছে। বললেন, হে আল্লাহ! হে আমার মালিক! জানি না আমার স্ত্রী হাওয়া কোথায় আছে? কেমন আছে? সেও জানে না আমি কোথায় আছি? কেমন আছি? হে প্রভু! আপনি আমার স্ত্রীর গুনাহ মাফ করে দিন। আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিন! আমাদের দুজনের প্রতি করুনা করুন হে আমার মাবুদ।
প্রার্থনা শেষ করে চোখ মেললেন হজরত আদম। চোখ মেলে তাকালেন সামনের দিকে। সামনে তাঁর মরুভূমি। বিস্তৃত মরুভূমি প্রান্তর।
হজরত আদম কি যেন দেখলেন। উত্তপ্ত মরুভূমির বুকে কিছু একটা দেখতে পেলেন তিনি। তিনি দেখলেন, বালুময় মরুভূমির বুক চিড়ে কিছু একটা এগিয়ে আসছে। কেউ একজন হেঁটে চলছে একা একা।
আরো স্পষ্ট হলো দৃশ্য। আরো কাছে! আরো কাছে চলে এলো আগন্তুক। হজরত আদম দেখলেন, এতো তাঁর স্ত্রী। জেদ্দার দিক থেকে হজরত হাওয়াই এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। এটা দেখে আর বসে থাকতে পারলেন না হজরত আদম। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দৌঁড় দিলেন এবং চিৎকার করে ডাকলেন হাওয়া বলে।
হাওয়া! হাওয়া!! এই হাওয়া!!!
এই যে আমি এখানে; আমি, আমি তোমার স্বামী আদম!
হজরত আদম আলাইহিস সালামের চিৎকার শুনে হজরত হাওয়াও চিনলেন আদমকে। তিনিও দৌঁড়ালেন আদমের দিকে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কাছাকাছি চলে এলেন দুজনেই। কাছাকাছি এলেন এবং একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। প্রিয়তম মানুষকে কাছে ফিরে পাওয়ার আনন্দে কাঁদলেন তাঁরা। আনন্দের কান্না কাঁদলেন নবি ও নবিপতœী। হজরত আদম ও হজরত হাওয়া আলাইহিমাস সালাম।
দীর্ঘদিন বিচ্ছেদের পর মিলিত হলেন তাঁরা। মিলিত হলেন আদম ও হাওয়া।
বন্ধুরা! আমরা বর্তমানে সৌদি আরবের যে স্থানটিকে আরাফাতের ময়দান বলে জানি; তোমরা কি জানো এই স্থানটিতে কেন আরাফাতের ময়দান বলা হয়?
আরাফাহ আরবি শব্দ। অর্থ হলো পরিচিতি, নিশানা, আলামত বা উচু জায়গা। মক্কার যে স্থানটিতে হজরত আদম ও হজরত হাওয়ার দেখা হয়েছিলো, অনেক দিন পর তাঁদের এই দেখা বা মিলন হওয়ার কারণেই ঐ স্থানটিকে আরাফাতের ময়দান বলা হয়।
একে অপরকে খুঁজে পেলেন আদম-হাওয়া। শুরু হলো তাঁদের পৃথিবীর জীবন। শুরু হলো পৃথিবীর সংসার। বাবা আদম ও মা হাওয়ার সংসার। মাটির পৃথিবীতে মাটির মানব-মানবীর জীবন-সংসার।

*

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

Recent Posts