চল্লিশ দিন(চিল্লা) কিংবা চার মাসের(তিন চিল্লা) যে চল আমরা দেখি এ সম্পর্কে কি বিধান রয়েছে ?
প্রশ্নঃ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমান ভাইদের ইসলামের দিকে ডাকার জন্যে চল্লিশ দিন(চিল্লা) কিংবা চার মাসের(তিন চিল্লা) যে চল আমরা দেখি এ সম্পর্কে কি বিধান রয়েছে ?
প্রশ্নটির উত্তর করেছেন শাইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ
উত্তরঃ প্রশংসা আল্লাহর জন্যে,
“জামায়াত আল-তাবলীগ” একটি ইসলামিক দল যারা ইসলামের জন্যে কাজ করছে। তাদের আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকার এই প্রচেষ্টা(দাওয়াহ) কে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু অন্যান্য অনেক দলের মত তাদেরও কিছু ভুল রয়েছে, এবং তাদের কিছু বিষয় লক্ষ্যণীয়। এখানে এসকল বিষয়াদি আলোচনা করা হল, উল্লেখ্য, এই ভুলগুলোর প্রকটতা তারা যে পরিবেশ কিংবা সমাজে অবস্থান করছে তার উপর নির্ভর করে কিছু কম-বেশি হতে পারে। যে সমাজ ইলম ভিত্তিক এবং আলেমগণ বিদ্যমান ও আহলে সুন্নাহ আল জামায়াহ’র মাযহাব সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সেখানে এই ভুলগুলো অনেক কম, আবার অন্য কোন সমাজে এই ভুলগুলো বেশিও হতে পারে। তাদের কিছু ভুল হলঃ
(১) আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ’র আকিদাহ গ্রহণ না করা। এটা স্পষ্টভাবে দেখা যায় তাদের সদস্যদের আকিদাগত পার্থক্য থেকে। এমনকি তাদের কিছু মুরুব্বিদের(তাদের নেতা) মাঝেও এই আকিদাগত পার্থক্য লক্ষ্যণীয়।
(২) শরয়ী জ্ঞানের প্রতি তারা মনোযোগ দেয় না।
(৩) তারা কিছু কুর’আনের আয়াত এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যেভাবে আল্লাহ ইংগিত করেন নি। উদাহরণস্বরূপঃ তারা জিহাদের আয়াতগুলোকে এভাবে ব্যাখ্যা করে, “দাওয়াহ’র জন্যে বের হওয়া”। ‘খুরুজ’ (বাইরে বের হওয়া) ইত্যাদি শব্দবিশিষ্ট আয়াতসমূহকে তারা দাওয়াতের জন্যে বের হওয়া অর্থে ব্যাখা করে থাকে।
(৪) তারা তাদের দাওয়াতের জন্যে বের হওয়ার পদ্ধতিকে একটি ইবাদাহ’তে পরিণত করে। ফলে তারা কুর’আনের ভুল উদ্ধৃতি দিতে শুরু করে তাদের এই নিদৃষ্ট কিছু দিনের এবং মাসের কার্যক্রমকে সমর্থন জানানোর জন্যে। এই পদ্ধতি, যা তারা মনে করে কুর’আন ভিত্তিক দলিলের উপর প্রতিষ্ঠিত, সকল দেশ এবং পরিবেশে ছড়িয়ে আছে।
(৫) তারা কিছু জিনিস করে থাকে যা শরীয়াতের বিরুদ্ধে যায়, যেমন তাদের জন্যে দুয়া করার জন্যে কাউকে নিযুক্ত করা যখন দলটি দাওয়াতের জন্যে বের হয়, এবং তারা মনে করে তাদের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করে সেই নিযুক্ত লোকটি আন্তরিক (মুখলিস) কিনা এবং তার দুয়া কবুল কিংবা প্রত্যাখাত হয়েছে কিনা তার উপর।
(৬) দয়িফ (দুর্বল) এবং মাওযু (জাল) হাদীসের বহুল প্রচলন রয়েছে তাদের মাঝে, এবং এটা তাদের সাথে বেমানান যারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকার লক্ষ্যস্থির করেছে।
(৭) তারা মুনকারাত(মন্দ কাজ) সম্পর্কে কথা বলে না, এই ভেবে যে ভালো কাজে অংশগ্রহণ করাই যথেষ্ট। লোকজনের মাঝে যে সকল খারাপ কাজ বহুল প্রচলিত তা নিয়ে তারা কথা বলে না, অথচ এই উম্মতের স্লোগান হল-যা তারা পুনঃপুন বলে থাকে- তা হল;
“আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম”। [আলে ইমরান ৩-১০৪]
তারাই হলো সফলকাম যারা সৎ কাজে অংশগ্রহণ করে এবং অন্যায় কাজে বারণ করে, যারা শুধুমাত্র দুইটির একটি করে তারা নয়।
(৮) তাদের কেউ কেউ আত্ম-গরিমা এবং ঔদ্ধত্যের দোষে দুষ্ট, যার ফলে তারা অন্যদের ছোট করে দেখে, এমনকি আলেমদেরকেও তুচ্ছ জ্ঞান করে এবং তাদের অলস, অকর্মঠ এবং রিয়াকার বলে থাকে। কাজেই আপনি তাদের দেখবেন তারা কিভাবে সফর করেছে এবং বের হয়েছিল এসব নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত থাকতে, এবং তারা কি কি দেখেছিল তার বর্ণনা দিতে, যার ফলে উল্লেখিত অনাহূত ফল দেখা দেয়।
(৯) তারা তাদের দাওয়াতের জন্যে বের হওয়াকে অনেক ইবাদাহ’র থেকে শ্রেয়তর মনে করে থাকে যেমনঃ জিহাদ এবং ইলম অন্বেষণ, যদিও এই কাজগুলোর কোন কোনটি ফরযে আইন কিংবা ফরযে কিফায়া হয়ে থাকে।
(১০) তাদের অনেকে বেপরোয়া (audaciously) ফাতাওয়া প্রদান করে, এবং তাফসীর এবং হাদীস আলোচনা করে। এর কারণ তারা তাদের প্রত্যেক সদস্যকে মানুষের সামনে বক্তব্য দিতে অনুমতি দান করে এবং বক্তা ব্যাখা করে থাকে। এর ফলে তারা শরীয়াহ’র বিষয়সমূহ নিয়ে অজ্ঞতাসহকারে কথা বলে। অপরিহার্যভাবে তারা কোন ফিকহ’এর অর্থ, হাদীস কিংবা আয়াত নিয়ে কথা বলে অথচ তারা এ সম্পর্কে কিছুই পড়ালেখা করেনি বা কোন আলেমের নিকট হতে কিছু শুনেওনি। এমনকি তাদের অনেকে নও-মুসলিম অথবা মাত্রই ইসলামের দিকে ফিরে এসেছে।
(১১) তাদের অনেকে তাদের সন্তানাদি ও পরিবারের প্রতি উদাসীন। আমরা এই বিষয়ের তীব্রতা নিয়ে ৩০৪৩ নম্বর প্রশ্নে আলোচনা করেছি।
একারণে আলেমগণ তাদের সাথে লোকদের বের হতে অনুমতি দেন না ,তারা ব্যতীত যারা আলেমদের সাহায্য করতে চায় কিংবা নিজেদের ভুলকে সংশোধন করতে চায়।
আমরা জন-সাধারণকে তাদের থেকে আলাদা করে দিব না, বরং আমরা অবশ্যই তাদের ভুল সংশোধনে সচেষ্ট হব এবং উপদেশ দিব যেন তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে এবং তারা যেন কুর’আন ও সুন্নাহ অনুসারে সঠিক থাকে।
• এখানে জামায়াত আল-তাবলীগ সম্পর্কে কয়েকজন আলেমের ফাতাওয়া উল্লেখ করা হলঃ
১) শাইখ আবদ আল আযিয ইবন বায বলেন,
জামায়াত আল তাবলীগ; তারা আকিদা সম্পর্কে যথাযোগ্য ধারণা রাখে না, কাজেই তাদের সাথে বের হওয়ার অনুমতি নেই, তবে যার ইলম আছে এবং আহল সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ’র আকিদাহ সম্পর্কে যার সঠিকতা নির্ণয়ের এবং তা বুঝার ক্ষমতা আছে সে ব্যতীত, কেননা সে তাদেরকে পথ দেখাতে পারবে, উপদেশ দিতে পারবে এবং ভালো কাজে তাদের সাথে সাহায্যও করতে পারবে কারণ তারা খুবই কর্মপরায়ণ। কিন্তু তাদের আরও অনেক ইলম অর্জন করা প্রয়োজন এবং তাওহীদ ও সুন্নাহ সম্পর্কে পথ নির্দেশনা দেবার ক্ষমতা রাখে এমন ব্যক্তিদের দরকার। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রহমত দান করুন ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝার ক্ষমতা দিয়ে এবং তা ধরে রাখার কাজে দৃঢ়তা দান করুন।
মাযমু ফাতাওয়া আল শাইখ ইবন বায, ৮/৩৩১
২) শাইখ সালিহ আল ফাওযান বলেন,
আল্লাহর জন্যে বের হওয়া বলতে তারা যে ধরণের বের হওয়াকে বুঝে থাকে আসলে তা নয়। আল্লাহর জন্যে বের হওয়া বা আল্লাহর রাস্তা বলতে বোঝায় জিহাদের জন্যে বের হওয়াকে। তারা বের হওয়ার জন্যে যেভাবে আহবান করে থাকে তা একটি বিদ’আত যা সালাফদের থেকে বর্ণিত নেই, অর্থাৎ সালাফদের কেউ এভাবে বের হওয়ার জন্যে আহবান করেন নি।
আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকার জন্যে বের হওয়াকে কয়েকটি দিনের মাঝে সীমাবদ্ধ করা যায় না, বরং একজন মানুষ তার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে লোকদের আল্লাহর দিকে আহবান করবে, তার এই সামর্থ্যকে সে কোন নির্দিষ্ট কিছু দিন যেমন চল্লিশ দিন বা এর কিছু বেশি বা কম অথবা কোন দলের মাঝে সীমাবদ্ধ করবে না।
অনুরূপভাবে, একজন দায়ীর অবশ্যই ইলম থাকতে হবে। একজন লোকের অনুমতি নেই সে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করবে অথচ যে একজন অজ্ঞ মূর্খ বা জাহেল।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “(হে নবী,এদের) তুমি বলে দাও, এ হচ্ছে আমার পথ; আমি মানুষদের আল্লাহর দিকে আহবান করি; আমি ও আমার অনুসারীরা পূর্ণাংগ সচেতনতার সাথেই আহবান জানাই; আল্লাহ তায়ালা মহান, পবিত্র এবং আমি কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই”। [সূরা ইউসুফ ১০৮]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “(হে নবী,এদের) তুমি বলে দাও, এ হচ্ছে আমার পথ; আমি মানুষদের আল্লাহর দিকে আহবান করি; আমি ও আমার অনুসারীরা পূর্ণাংগ সচেতনতার সাথেই আহবান জানাই; আল্লাহ তায়ালা মহান, পবিত্র এবং আমি কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই”। [সূরা ইউসুফ ১০৮]
দ্রষ্টব্য; “সচেতনতার সাথেই আহবান জানাই”, এ আহবান হতে হবে ইলমের সাথে কারণ একজন আহবানকারী যেদিকে লোকদেরকে আহবান করছে তা সম্পর্কে তাকে অবশ্যই জানতে হবে। তাকে জানতে হবে কোনটি ফরয, মুস্তাহাব, হারাম আর কোনটি মাকরুহ। তাকে জানতে হবে শিরক সম্পর্কে; পাপকার্য, কুফর, অনৈতিকতা, অবাধ্যতা সম্পর্কে। অন্যায়ের এবং মন্দ কাজের কিভাবে মোকাবিলা করতে হয় সে সম্পর্কেও তাকে অবশ্যই জানতে হবে।
এ ধরণের বের হওয়া (চল্লিশ দিন কিংবা চার মাস) মানুষকে ইলম অর্জন থেকে বিঘ্নিত করে এবং এটি একটি ভুল, কারণ ইলম অর্জন করা একটি অত্যাবশ্যক বা ফরয কাজ, আর এটা কেবলমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই অর্জন করা যায়, অনুপ্রেরণার মাধ্যমে নয়। এটা হল এক প্রকার ভুল পথে চালিত সুফী মিথ(myth), কেননা ইলম ছাড়া আমল হল ভুল পথে চলা বা পথভ্রষ্টতা আর শিক্ষা অর্জনের প্রক্রিয়া ছাড়া ইলম অর্জনের আশা করা একটি বিভ্রম ব্যতীত আর কিছু নয়।
- সালাস মিহাদারাত ফিল-ইলম ওয়াল দাওয়াহ থেকে।
আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন।
ফতোয়া প্রদানেঃ শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-মুনাজ্জিদ